সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

চৈতন্য হত্যার অনুসন্ধানে - তমাল দাশগুপ্ত

প্রথম পর্ব 

পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের পাণ্ডাদের মধ্যে একটা ভীষণ প্রবাদ চালু আছে, মালীবুড়োর শ্রীচৈতন্যের অন্তর্ধান রহস্য বইটা আমাদের জানাচ্ছে। এই পাণ্ডারা অনেকেই গর্ব করে বলে যে চৈতন্যকে তাদের পূর্বপুরুষেরা হত্যা করেছিল।
কেন করেছিল? এরা বলে, এর কারণ চৈতন্য নাকি বাংলার মুসলমান শাসকের চর ছিলেন! আর তাই চৈতন্যর উড়িষ্যায় আগমনের পরেই প্রথমবারের জন্য গৌড়ের মুসলমান শাসক উড়িষ্যায় সফলভাবে হামলা করতে পেরেছিল। সাহসীজন এ ব্যাপারে পুরীতে গিয়ে উড়িয়া পাণ্ডাদের মধ্যে খোঁজখবর করে দেখতে পারেন এরকম একটা কথা চালু আছে কি না ।
চৈতন্য আন্দোলনের ফলে উড়িষ্যায় মুসলমান হামলা হয়েছিল, এই বক্তব্য এমনই জোরালো হয়ে ওঠে ক্রমে, যে প্রভাত মুখার্জি তার মেডায়েভাল বৈষ্ণবিজম ইন ওড়িশা গ্রন্থে এটিকে রীতিমত তথ্য ও যুক্তি দিয়ে খণ্ডন করেছেন, অর্থাৎ এটি উড়িয়ে দেওয়ার মত অকিঞ্চিতকর প্রলাপ নয়, অনেক উড়িষ্যাবাসী এতে বিশ্বাস করেন। ইন ফ্যাক্ট খোঁজ নিলে দেখবেন, অনুরূপ চাপা চৈতন্যবিদ্বেষ বাংলাভাষী হিন্দুত্ববাদীদের অনেকের আছে, এরাও একইরকম মনে করে।
আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি যে চৈতন্যর সাম্যময় ভক্তি আন্দোলনের ফলে পাণ্ডাদের মৌরসীপাট্টায় খুবই বাধা পড়ছিল। তাছাড়াও সে যুগেও এক শ্রেণীর উড়েদের ভেতরে বাঙালিবিদ্বেষ পুরোমাত্রায় ছিল। এজন্য চৈতন্যের নামে এই অপবাদটি ছড়ানো হয়েছিল এবং তাকে হত্যা করা হয় মন্দিরের ভেতরেই।
সেযুগের উৎকল বৈষ্ণবেরা প্রেম ও ভক্তির উৎস হিসেবে রাধা-কৃষ্ণকে মানতেন না। বলতেন রাধা ও কৃষ্ণের সম্পর্ক ভাই বোনের। সেটাও আরেকটা বড় পার্থক্য ঘটায় গৌড়ীয় বৈষ্ণব আন্দোলনের সঙ্গে। একসময় মনান্তর এমন পর্যায়ে পৌঁছয় যে গৌড়ীয় ভক্তরা সবাই পুরী ত্যাগ করে বৃন্দাবনে চলে যান, চৈতন্যের জীবদ্দশাতেই।
আজকে রসগোল্লা যখন ইতিহাসবিকৃতির শিকার হয়ে বাঙালির হাতছাড়া, চর্যা যখন চুরি যাচ্ছে, কবি জয়দেব যখন সম্পূর্ণ বেহাত, তখন চৈতন্য হত্যার ইতিহাস পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে স্টাডি করতেই হবে। একটা আগ্রাসনকে বুঝতে গেলে তার ইতিহাসকে বুঝতে হয়।
অন্যদিকে, বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে সর্বদাই চৈতন্য আন্দোলন থেকে শিখতে হবে। তার প্রাপ্তি থেকে শিখতে হবে। তার ওপরে আসা আঘাতের ইতিহাসকে অধ্যয়ন করে আগামীর আঘাত প্রতিহত করার শিক্ষা নিতে হবে।
চৈতন্যর পূর্বপুরুষ সিলেট থেকে এসেছিলেন, সমসাময়িক সমস্ত জীবনীকার তাই বলছেন। উড়িষ্যার যাজপুর থেকে তারা সিলেটে গেছিলেন, এরকম কোনও কথা চৈতন্যের সমসাময়িক কোনও বাঙালি জীবনীকার বলেন নি। মধ্যযুগের উড়িষ্যার কবি মাধব পট্টনায়ক প্রথম বললেন, যে চৈতন্যদেবের পূর্বপুরুষ উড়িষ্যার যাজপুর থেকে সিলেট গেছিলেন। এই মাধব পট্টনায়কই কবি জয়দেবকে উড়িয়া বলে দাবী করেছিলেন প্রথম। দু-দুটো বৃহৎ ঢপের প্রথম জন্মদাতা এই মাধবের বিষয়ে খুব বেশি কিছু জানা না গেলেও, এই লোকটি চৈতন্যের সময়ে উড়িষ্যার পঞ্চসখা বৈষ্ণবদের দলেরই একজন অনুগামী ছিলেন, সেটা জানা যায়।
এরপর বাঙালি কবিদের মধ্যে প্রথম জয়ানন্দই "চৈতন্যের পূর্বপুরুষ উড়িয়া ছিলেন" মাধবের এই বক্তব্যটি রিপিট করেন, তারপর থেকে ওই যাজপুরের কথাটা চলেছে। প্রসঙ্গত, এই জয়ানন্দই বলেছিলেন যে চৈতন্যর মৃত্যু ইঁটের খোঁচায় হয়েছিল, আর কোথাও সে বক্তব্য পাওয়া যায় না।
চৈতন্য যে শ্রেণীর ব্রাহ্মণ ছিলেন, অর্থাৎ পাশ্চাত্য বৈদিক, সে শ্রেণীর ব্রাহ্মণ উড়িষ্যায় মেলে না, যদিও মিশ্র পদবী দেখা যায়, সেখান থেকেই জালসাজির সূত্রপাত।
                                                                      ****



দ্বিতীয় পর্ব 
কেন এই যাজপুর তত্ত্ব চৈতন্য অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে একটা বড় বিড়ম্বনা? তার প্রধান কারণ হল যে এই থিওরি মানলে চৈতন্যের ওপরে পাণ্ডাদের মারাত্মক বিদ্বেষের পটভূমিটাই বোঝা যায় না, গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের অত্যুচ্চ আদর্শের সঙ্গে চৈতন্য আন্দোলনের পূর্ববর্তী ও সমসাময়িক উৎকলের জগন্নাথমন্দির কেন্দ্রিক ঘেঁটে ঘ উৎকেন্দ্রিক বৈষ্ণব ধর্মের দ্বন্দ্বটা বোঝা যায় না। চৈতন্য যে বাঙালি বলেই নিহত হয়েছিলেন, সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।
আগে যাজপুর থেকে সিলেটে যাওয়ার মিথটির ব্যাপারে বলি।
চৈতন্যের থেকে বয়েসে একটু বড়, চৈতন্যের ঘনিষ্ঠ সঙ্গী মুরারি গুপ্ত, চৈতন্য কড়চা লিখেছেন সংস্কৃত ভাষায়, সেটাই চৈতন্যের প্রথম জীবনীগ্রন্থ। এতে চৈতন্যের পূর্বপুরুষদের যাজপুর থেকে আসার কোনও দূরদূরান্তের ইঙ্গিত নেই। এরপর চৈতন্যের আরও অনেকগুলো জীবনীগ্রন্থ রচিত হয়, সেখানেও এমন কিছুর উল্লেখ নেই। মাধব পট্টনায়ক, উড়িয়া কবি, তার চৈতন্য বিলাস গ্রন্থে (১৫১৬) দাবী করেছিলেন, যে চৈতন্যর পূর্বপুরুষ ছিলেন উড়িয়া, মধুকর মিশ্র যাজপুর থেকে গেছিলেন সিলেটে। এই প্রথম এই দাবী উচ্চারিত হল। উল্লেখ্য গীতগোবিন্দের কবি জয়দেবকেও উড়িয়া বলে দাবী করেছিলেন প্রথম এই মাধব পট্টনায়কই। অর্থাৎ এর একটা প্রবণতাই ছিল বিখ্যাত বৈষ্ণব (জয়দেব অবশ্যই বৈষ্ণব সাধু ছিলেন না, তিনি রাজসভার কবি ছিলেন, রাজসিক ছিলেন। এমনকি তার একটা বীররসের কাব্যও ছিল, যেটা হারিয়ে গেছে, কিন্তু তার কিছু শ্লোক পাওয়া যাচ্ছে ইতিউতি, নীহাররঞ্জন জানাচ্ছেন। এছাড়া জয়দেব বাঙালির নিজস্ব সহজিয়া আদিরসের রসিক, তিনি যৌনতায় সাবলীল। কিন্তু এই মাধব একেবারে জয়দেবকে ভক্ত সাধুসন্ত বানিয়ে সেরেছেন, যিনি নাকি পুরীর কাছে কেঁদুলিশাসন গ্রামে জন্মান এবং কস্মিনকালে তিনি উৎকলের বাইরে যান নি, পুরীর মন্দিরে বসেই গীতগোবিন্দ লেখেন। আমার জয়দেব সংক্রান্ত ইংরেজি প্রবন্ধে এই দাবিগুলোর বিস্তারিত খণ্ডন করেছি) ব্যক্তিদের উড়িয়া বলে দাবী করার। জয়দেব সংক্রান্ত প্রবল মিথ্যাচারিতা যিনি করেছেন, সেই ব্যক্তির চৈতন্য সংক্রান্ত তথ্যকে সত্যি বলে ভাবার কারণ আছে কি? এবং বাঙালিদের মধ্যে এই যাজপুর প্রথম উল্লেখ পাই জয়ানন্দে, যিনি তাঁর চৈতন্য জীবনীটি লেখেন সম্ভবত ১৫৪৮ থেকে ১৫৬০ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে। জয়ানন্দের সোর্স মাধব। এরপর থেকে ক্রমে ক্রমে বাংলার বৈষ্ণবরাও এই যাজপুর তত্ত্বটি মেনে নেন।
সেযুগে গৌড়ে মুসলমান শাসক। শ্রীহট্টেরও পতন ঘটেছে। বিজয়গুপ্ত তাঁর কাব্যে জানিয়েছেন, কিভাবে হিন্দুদের ওপরে অত্যাচার ঘটত। মধ্যযুগের বাংলার বিবরণ সুকুমার সেন চমৎকার ভাবে দিয়েছেন তার বইতে, সেটা আগ্রহীরা পড়ে নিতে পারেন। এইসময়কার বিবরণ তুহিনবাবুর লোকায়ত শ্রীচৈতন্য বইতেও খুব নিরপেক্ষভাবে দেওয়া আছে, সেটাও পড়ে নিতে পারেন। প্রশ্ন হল, এইসময় কে যাবে সিলেটে, হিন্দুরাজ্য যাজপুর ছেড়ে? যাজপুরের রাজা অত্যাচারী, ভালো কথা, কিন্তু সেখান থেকে তাই বলে সোজা যবন শাসনাধীন সিলেট? এ তো পশ্চিমবঙ্গে তৃণ অরাজকতা আছে বলে আফগানিস্তানে গিয়ে সেটল করার সিদ্ধান্তের মত আজগুবি। শাহজালালের সময় (১৩০৩) থেকেই তো সিলেটের অধিকার মুসলমানদের হাতে। চৈতন্যের প্রপিতামহ মধুকর মিশ্র (তাঁর পুত্র উপেন্দ্র, তাঁর পুত্র জগন্নাথ, জগন্নাথের পুত্র চৈতন্য) এই ডামাডোলের মধ্যে কোন আহ্লাদে যাজপুর ছেড়ে সিলেটে থাকতে যাবেন, যেরকমটা দাবী করা হয়েছে মাধব অনুসারী জয়ানন্দের বয়ানে?
বরং চৈতন্যর পিতা যে সিলেটে ইসলামিক উপদ্রব থেকে বাঁচতে নবদ্বীপে চলে আসেন, সেটা সহজেই বোঝা যায়। ওই সময়ে আরও অনেক ব্রাহ্মণ সিলেট থেকে নবদ্বীপে চলে এসেছিলেন, নবদ্বীপের চৈতন্য আন্দোলনে এই পূর্ববঙ্গ থেকে চলে আসা মানুষজন একটা বড় ভূমিকা পালন করেছেন। এবং এই পূর্ববঙ্গীয় ব্যাপারটাই পাই বারবার। কোথাও একবারের জন্যও চৈতন্যর ঠাকুরদা যে উড়ে ছিলেন, সেই প্রসঙ্গ চৈতন্যের সমসাময়িক বাঙালি সঙ্গীসাথীরা বলছেন না।
এইসব কারণে আমার ধারণা মধুকর মিশ্র সিলেটেরই আদি বাসিন্দা ছিলেন, যাজপুর থেকে যান নি। তাছাড়াও চৈতন্যর বংশটি ছিল পাশ্চাত্য বৈদিক (“আসী শ্রীহট্ট মধ্যস্থ্যে মিশ্রোমধুকরাভিধঃ । পাশ্চাত্যে বৈদিকবিশ্বেব তপস্বী বিজিতন্দ্ৰিয়ঃ।" -শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যোদয়াবলী), এই শ্রেণীর ব্রাহ্মণ যে উড়িষ্যায় মেলে না, সেটা জোর দিয়ে বলছেন চৈতন্য গবেষক বিমান বিহারী মজুমদার এবং মৃত্যুঞ্জয় মণ্ডল। উভয়েই যাজপুর তত্ত্বের প্রবল বিরোধিতা করেছেন, এবং ওটিকে অসত্য বলেছেন। ঐতিহাসিক যুক্তিগুলো এঁদের লেখায় পাবেন।
কিন্তু আমার মতে চৈতন্য সবার আগে একজন বাঙালি ছিলেন, চৈতন্য হত্যার অনুসন্ধান করতে গেলে সবথেকে আগে এই সত্যটিকে অনুধাবন করতে হয়। সেযুগের বাঙালিত্বের মন্থনে যে অমৃত উঠে এসেছিল, তার নাম শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য। বাঙালির হিয়া অমিয় মথিয়া নিমাই ধরেছে কায়া, সাধে কি আর কবি লিখেছিলেন? সেই চৈতন্য কেন, কি পরিস্থিতিতে আক্রান্ত হয়েছিলেন, সেটার উত্তর চৈতন্য কে ছিলেন, চৈতন্য কি ছিলেন, তার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীকভাবে জড়িত।
চৈতন্যলীলা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা আমাদের আওতার বাইরে। এবার সরাসরি তাঁর নীলাচলে যাওয়ার প্রসঙ্গে আসব, তারপরে মৃত্যুপ্রসঙ্গ।
****


 তৃতীয় পর্ব 
সেসময়ের নবদ্বীপ এক মহামন্থনস্থল। ন্যায়শাস্ত্র অধ্যয়নের কেন্দ্রবিন্দু তখন নবদ্বীপ, একের পর এক মহাধনুর্ধর পণ্ডিতের আবির্ভাব ঘটছে সেখানে। বঙ্কিমের ভাষায়, এই সময়ে বাঙালির প্রথম রেনেসাঁস।
“ইউরোপ সভ্য কত দিন? পঞ্চদশ শতাব্দীতে অর্থাৎ চারি শত বতসর পূর্ব্বে ইউরোপ আমাদিগের অপেক্ষাও অসভ্য ছিল। একটি ঘটনায় ইউরোপ সভ্য হইয়া গেল। অকস্মাৎ বিনষ্ট বিস্তৃত অপরিজ্ঞাত গ্রীকসাহিত্য ইউরোপ ফিরিয়া পাইল। ফিরিয়া পাইয়া যেমন বর্ষার জলে শীর্ণা স্বোতস্বতী কুলপরিপ্লাবিনী হয়, যেমন মুমূর্ষু রোগী যৌবনের বলপ্রাপ্ত হয়, ইউরোপের অকস্মাৎ সেইরূপ অভ্যুদয় হইল। … আমাদিগেরও একবার সেই দিন হইয়াছিল। অকস্মাৎ নবদ্বীপে চৈতন্যচন্দ্রোদয়; তার পর রূপসনাতন প্রভৃতি অসংখ্য কবি ধর্ম্মতত্ত্ববিৎ পণ্ডিত। এ দিকে দর্শনে রঘুনাথ শিরোমণী, গদাধর, জগদীশ; স্মৃতিতে রঘুনন্দন, এবং তৎপরগামিগণ। আবার বাঙ্গালা কাব্যের জলোচ্ছ্বাস। বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস, চৈতন্যের পূর্ব্বগামী। কিন্তু তাহার পর চৈতন্যের পরবর্ত্তিনী যে বাঙ্গালা কৃষ্ণবিষয়িণী কবিতা, তাহা অপরিমেয় তেজস্বিনী, জগতে অতুলনীয়া; সে কোথা হইতে?
আমাদের এই Renaissance কোথা হইতে? কোথা হইতে সহসা এই জাতির এই মানসিক উদ্দিপ্তী হইল? এ রোশনাইয়ে কে কে মশাল ধরিয়াছিল? ধর্ম্মবেত্তা কে? শাস্ত্রবেত্তা কে? দর্শনবেত্তা কে? ন্যায়বেত্তা কে? কে কবে জন্মিয়াছিল? কে কি লিখিয়াছিল? কাহার জীবনচরিত কি? কাহার লেখায় কি ফল? এ আলোক নিবিল কেন? নিবিল বুঝি মোগলের শাসনে। হিন্দু রাজা তোড়লমল্লের আসলে তুমার জমার দোষে।” (বাঙ্গালার ইতিহাস সম্বন্ধে কয়েকটি কথা)
শিশিরকুমার ঘোষ এই প্রসঙ্গে অমিয় নিমাই চরিতে বলছেন বাসুদেব সার্বভৌমের কথা, যিনি সমস্ত ন্যায়শাস্ত্র কণ্ঠস্থ করে এনেছিলেন মিথিলা থেকে (কারণ মিথিলার পণ্ডিতরা গৌড়ীয় ব্রাহ্মণের মেধাতীক্ষ্ণতায় আশঙ্কিত হয়ে কোনও পুঁথি মিথিলা থেকে নিয়ে বাইরে যাওয়া নিষিদ্ধ করেছিলেন)।
“সার্বভৌম যখন টোল বসাইলেন, তখন রঘুনাথ, রঘুনন্দন, কৃষ্ণানন্দ প্রভৃতি ছাত্রগণ সেখানে বিদ্যা উপার্জন করিতেছিলেন, এবং সার্বভৌম টোল করিলেই উহারা সকলেই তাঁহার টোলে প্রবেশ করিলেন।
রঘুনাথ – ইনি দিধীতির গ্রন্থকার। ন্যায়ের এরূপ গ্রন্থ আর তাঁহার ন্যায় নৈয়ায়িক জগতে আর সৃষ্ট হয় নাই।
ভবানন্দ – ইনি রঘুনাথের সমকক্ষ জগদীশের গুরু। ইহাই বলিলে যথেষ্ট হইবে যে পণ্ডিত জগদীশের নামে ন্যায়শাস্ত্রকে জাগদিশী বলে।
রঘুনন্দন – ইনি স্মার্ত ভট্টাচার্য। ইনি স্মৃতি অষ্টবিংশতি অধ্যায়ে বিভক্ত করিয়া যে স্মৃতি তত্ত্বের সৃষ্টি করেন, তাহা অদ্যাবধি বাংলায় রাজত্ব করিতেছে।
কৃষ্ণানন্দ – ইনি তন্ত্রসার গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। ইনি তন্ত্রসারের রাজা।
এই সকল লোক চিরদিন পূজিত থাকিবেন। ইঁহাদের ন্যায় পণ্ডিত বঙ্গদেশে প্রায় কেহ জন্মগ্রহণ করে নাই।” (অমিয় নিমাই চরিত)
বাসুদেব সার্বভৌমের টোলের ছাত্রদের মধ্যে নিমাই-ও ছিলেন। তিনি কিছুদিন এখানে পড়েছিলেন।
সার্বভৌম এরপরে নবদ্বীপ ছেড়ে উড়িষ্যায় চলে যান। সেযুগের শ্রেষ্ঠতম বাঙালি অধ্যাপক পুরীতে গিয়ে টোল খুলে বসেন, যার পেছনে রাজনৈতিক কারণ থাকা খুবই সম্ভব। বাঙালির প্রজ্ঞা উৎকলকে নিয়ন্ত্রণ করলে তাতে হিন্দুধর্মের ও হিন্দুসমাজের মঙ্গল ছিল, ভারতের মঙ্গল ছিল। পরবর্তীতে এই সার্বভৌমের নেটওয়ার্কই ব্যবহার করবেন চৈতন্য স্বয়ং। সার্বভৌমের প্রস্থানের সঙ্গে প্রাচীন যুগে অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের তিব্বতে চলে যাওয়ার সামান্য মিল আছে, কিন্তু অতীশ চলে যাওয়ায় ভারত অন্ধকার হয়ে গেছিল বলা হয়, সেটা বাসুদেবের প্রস্থানের ফলে বাংলার ক্ষেত্রে হয়নি, কারণ তাঁর হাতে গড়া তাঁর যোগ্য উত্তরসূরীরা ছিলেন। নবদ্বীপ তখন বাংলার শুধু নয়, ভারতের শ্রেষ্ঠতম শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে।
                                                                              ****



চতুর্থ পর্ব
এখানে একটা কথা বলা দরকার। চৈতন্য হত্যা নিয়ে আমাদের আলোচনায় উড়ে পাণ্ডাদের প্রতি মনোযোগ সীমাবদ্ধ থাকে সাধারণত, কিন্তু সর্ষের মধ্যেও তো ভূত থাকতে পারে, এবং আছে। অর্থাৎ চৈতন্যকে নিয়ে ইতিহাসনিষ্ঠ আলোচনায় একদল বাঙালিও প্রাণপণে ব্যাগড়া দিয়েছেন। নমুনা দিচ্ছি নিচে। চৈতন্য গবেষণায় যা যা এদের মনঃপূত হয় না, সেগুলো নিষিদ্ধ করার চেষ্টা গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের একদল করেছেন। প্রকাশ্যে এরা বলেন, চৈতন্য ঐশ্বরিক চরিত্র, তাঁর ওপরে মানবতা আরোপ করে তাঁকে পাণ্ডাদের হাতে নিহত দেখালে বৈষ্ণবধর্মের আধ্যাত্মিক চেতনা নষ্ট হয়। গোপনে গোপনে যে এরা কাদের দালালি করছেন, সে এক বিপজ্জনক সম্ভাবনার জগত।
উড়েদের জয়দেব-চুরির বিরুদ্ধে সবথেকে অসাধারণ কাজ করেছিলেন প্রশান্ত দাশগুপ্ত, তার বাংলা ইংরেজি দুটো বই-ই আউট অফ প্রিন্ট হয়ে আছে, কোথাও পাওয়া যায় না। কেন কে জানে! এদিকে, “চৈতন্যকে কেন্দ্র করে তথ্যলোপের ঘটনা নতুন কিছু নয়”, তুহিন মুখোপাধ্যায় জানাচ্ছেনঃ “স্বরূপ দামোদরের 'কড়চা' আজও আবিষ্কৃত হয়নি, যেমন খুঁজে পাওয়া যায়নি বৃন্দাবনদাস রচিত 'চৈতন্যভাগবত'এর শেষ অংশ। অনেকেই সন্দেহ করেন, বিশেষ কোনও উদ্দেশ্যে এই গ্রন্থ দুটিকে নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, মুরারি গুপ্তের 'কড়চা'র মূল পুঁথিটিও কিন্তু খুঁজে পাওয়া যায় নি। … ঐতিহাসিক ড. অমূল্যচন্দ্র সেন-এর লেখা 'ইতিহাসের শ্রীচৈতন্য' গ্রন্থটিও (সেপ্টেম্বর ১৯৬৫) বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের প্রতিবাদে পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ হয়।”
বিমান বিহারী মজুমদারের চৈতন্যচরিতের উপাদান হল চৈতন্য গবেষণার এক অমূল্য আকরগ্রন্থ। মজার ব্যাপার হল, এই বিমান বিহারী নিজেই রসরাজ গৌরাঙ্গ -স্বভাব নামে একটা বইয়ের সমস্ত কপি খুঁজে খুঁজে এনে নষ্ট করিয়েছিলেন, বইটির বিরুদ্ধে চৈতন্য চরিত্রে অশ্লীলতা আরোপের অভিযোগ তুলে, তুহিন মুখোপাধ্যায় জানাচ্ছেন। সে বইতে কি লেখা হয়েছিল আর জানার উপায় নেই বলে অভিযোগের যথার্থতা যাচাই করা আর সম্ভব নয়। তবে চৈতন্য আন্দোলনকে ধর্মীয় গোঁড়ামি ও শুচিবাই দিয়ে মাপতে গেলে ভুল হয়। এর উৎসে যে বাংলার সহজসাধনা, তা ভুলে গেলে এর প্রতি মহা অবিচার ঘটে।
কালকূটের জ্যোতির্ময় শ্রীচৈতন্য উপন্যাসে চৈতন্যহত্যার কথা বলা হয়েছে। এখন সেই উপন্যাসে কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্যচরিতামৃত থেকে যে উদ্ধৃতি রয়েছে (যাতে দাবী করা হয়েছে যে চৈতন্যের সহজিয়া সাধনার সঙ্গিনী ছিলেন সার্বভৌম কন্যা ষষ্ঠী), তুহিন মুখোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, সেটা আর কৃষ্ণদাসের রচনায় কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তবে কি চৈতন্যচরিতামৃতের মত মহাপুস্তকও সেনসরশিপের শিকার হয়েছে? চৈতন্যকে বাংলার সহজিয়া চেতনার ঐতিহ্য ও প্রেক্ষাপটে দেখতে কোন্‌ ব্রাহ্মণ্যবাদী, আধা-আব্রাহামিক, আধা-ভিক্টোরীয় এবং সম্পূর্ণ না-বাঙালি ধ্যানধারণা আজও বাধা দিয়ে চলেছে, সেটা আমাদের জানতে হবে। এদের সঙ্গে চৈতন্য-হন্তা পাণ্ডাতন্ত্রের কি কি যোগাযোগ আছে, এরা পাণ্ডাতন্ত্রের স্বাভাবিক মিত্র কি না, সেগুলোও আজ খতিয়ে দেখা দরকার।
                                                                              ****


 পঞ্চম পর্ব
চৈতন্যের ও তাঁর আন্দোলনের দুটি অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য, যা আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তা হল, এক, এই আন্দোলন পূর্ব ও উত্তর ভারতে বাঙালির চিরাচরিত প্রভাবাধীন ভূমিতে বাঙালির জীবনীশক্তিকে পুনরায় স্থাপিত করছিল। উত্তর ভারতে গয়া থেকে বারাণসী থেকে বৃন্দাবন, চৈতন্যের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা বৈষ্ণব ঘাঁটিগুলোর এই সারকিটটা দেখুন। আর এদিকে দক্ষিণদিকে বালাসোর (যেখানে ঈশ্বরপুরীর ঘাঁটি ছিল) থেকে পুরী - এ দেখে মনে হয় না, রাজা শশাঙ্কের, বা ধর্মপাল-দেবপাল, বা বল্লালসেন-লক্ষ্মণসেনের রাজ্যের মানচিত্র আবার অঙ্কিত হচ্ছে? কি আশ্চর্য! ইতিহাস কি রক্তকণিকায় প্রবাহিত হয়? সে ইতিহাস তো বিলুপ্ত, ধ্বংস, চৈতন্যের সময়ে ভক্ত বৈষ্ণবে সে ইতিহাস, সে মানচিত্র পাঠ করেছে বলে মনেও হয় না। তা সত্ত্বেও আবার যে বাঙালি তার ঘর সাজাতে শুরু করল, সেই প্রাচীন গঙ্গারিডাই সভ্যতার দিনকাল থেকে সহস্র সহস্র বছর ধরে তার যে প্রভাববলয়, সেখানে আবার সে ডানা মেলতে শুরু করল, একে কি বলব, জাতিগত স্মৃতি? যাই হোক না কেন, চৈতন্য আন্দোলন ভারতভূমিতে বাঙালি মননের প্রাধান্যর পুনর্বিস্তারে আরেক পদক্ষেপ। চৈতন্যর পূর্বসূরী অদ্বৈত গোস্বামী দীক্ষা নিয়েছিলেন ঈশ্বরপুরীর কাছে, চৈতন্যের দীক্ষাও এই ঈশ্বরপুরীরই কাছে। এই ঈশ্বরপুরী বাঙালি বৈদ্যজাতে জন্ম নিয়েছিলেন, বাড়ি ছিল কুমারহট্টে (হালিশহরে)। চৈতন্য আন্দোলনের পেছনে বৈদ্যজাতের ভূমিকা নিয়ে একটা সম্পূর্ণ প্রবন্ধ হতে পারে, তবে সে অন্য কথা।
দ্বিতীয়ত, চৈতন্য-নিত্যানন্দের এই আন্দোলন সমসাময়িক ব্রাহ্মণ্যধর্মের গোঁড়ামির থেকে বেরিয়ে এসে সহজিয়া চেতনার পথে এ দেশ, এ সমাজের পুনরুজ্জীবনের পথে হাঁটছিল। যে মূর্খ পাণ্ডার দল কালাচাঁদ রায় সাতদিন ধরে পুরীর মন্দিরে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকার পরে তাকে দূরদূর করে তাড়িয়ে দেয় এবং সেই কালাচাঁদ পরে কালাপাহাড় হয়ে ফিরে আসে এই বিদ্বেষময়, গোঁড়া সনাতন ধর্মের বিরুদ্ধে নেমেসিস হয়ে, তাদের পক্ষে চৈতন্যের এই ভাব আন্দোলনের মর্ম বোঝা সম্ভব নয়। যে গৌড়ীয় ব্রাহ্মণরা সুবুদ্ধি রায়কে গরম ঘি খেয়ে কিংবা তুষানলে প্রবেশ করে আত্মহত্যা করতে বলেছিল (সুবুদ্ধিকে হুসেন শাহ মুসলমানের জল খাইয়ে তার ধর্মনষ্ট করেছিলেন, তারই পরিণতিতে সুবুদ্ধি হিন্দুসমাজ কর্তৃক পরিত্যক্ত হন, এবং সুবুদ্ধি যখন হিন্দুসমাজে ফেরার জন্য ব্রাহ্মণদের কাছে নিদান চান, তখন এই চমৎকার ব্যবস্থা করেন সেই ব্রাহ্মণেরা), সেই ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র বাংলার স্ব-ভাব নয়। সেই নির্মম, সঙ্কীর্ণ, নির্বোধ, ছুঁৎমার্গী, অমানবিক ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র বাংলার নিজস্ব নয়। সুবুদ্ধি রায়কে চৈতন্য বাঁচিয়েছিলেন। যখন সুবুদ্ধি বারাণসীতে গমন করেন, নিদান চাইতে, সেখানে ভাগ্যবশতঃ চৈতন্যের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়, এবং সুবুদ্ধি রায়কে চৈতন্য বৃন্দাবনে প্রেরণ করেন। শিশির ঘোষ তাঁর অমিয় নিমাই চরিতে এই ঘটনাটি দিয়ে উপক্রমণিকা শুরু করছেন। অর্থাৎ চৈতন্য ধর্মের স্বরূপ হল এর মানবিক অ্যাপ্রোচ, যা একান্তভাবেই বাংলার সহজিয়া সাধনার ঐতিহ্য। এবং বাংলার মুসলমান শাসকের আগ্রাসনের মুখোমুখি চৈতন্যের স্ট্র্যাটেজির যে সুদূরপ্রসারী ভূমিকা আছে, সে তো বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু এই ধরণের স্ট্র্যাটেজি যখন তিনি জগন্নাথ মন্দিরে বসে নেবেন, তখন তাঁকে যে ধাক্কাটা সামলাতে হবে, সেটা শুধু পাণ্ডা-হিন্দুত্বের গোঁড়ামির নয়, সেটা তাদের বাঙালি-বিদ্বেষেরও বটে, যারা এই প্রেমধর্মকে বুঝতে পারে না, আর নিজেদের নির্বোধ ঘৃণাকেই হিন্দুধর্মের আকর বানিয়ে ফেলে। যে নিত্যানন্দ ছিলেন অবধূত, যিনি সমস্ত সঙ্কীর্ণ আচার-ব্যবহারের উর্ধ্বে, যাকে কোনও ছুঁৎমার্গে ফেলা যায় না, আর যে চৈতন্য ছিলেন সর্বজীবে সমকরুণার আকর, তারা বাঙালিকে রিপ্রেজেন্ট করেন, বাঙালির প্রকৃত প্রেমধর্মের প্রতিনিধি তাঁরা। পাণ্ডাধর্মের সঙ্গে প্রেমধর্মের ঠুকোঠুকি লেগেছিল, লাগাটা অবশ্যম্ভভাবী ছিল।
চৈতন্যকে বা জয়দেবকে উড়ে বানানোর পেছনে যে বাঙালি-বিদ্বেষ কাজ করছে, তাকে চেনা ও জানা খুবই দরকার। হরিদাসকে যখন গৌড়ীয় বৈষ্ণব মঠ ব্রাহ্মণ বানাতে চায় (আসলে ব্রাহ্মণের ঘরে জন্ম কিন্তু মুসলমান-গৃহে পালিত – এই মিথ ও মিথ্যার প্রচার করে। দীনেশ সেন বলছেন, হরিদাস জন্মসূত্রে মুসলমান ছিলেন, ব্রাহ্মণ ছিলেন না মোটেই, সমস্ত প্রাচীন নথি সেই সাক্ষ্যই দিচ্ছে। এবং জন্মসূত্রে মুসলমান ছিলেন বলেই এমন চরম শাস্তি দেওয়া হয়েছিল তাঁর হরিভক্তির। সে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি, বাইশটি বাজারে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বেত্রাঘাত করে মেরে ফেলা হবে, এমন আদেশ দিয়েছিলেন গৌড়ের সুলতান। অসম্ভব বলশালী দীর্ঘদেহী স্বাস্থ্যবান পুরুষ ছিলেন হরিদাস, তাই কোনওমতে বেঁচে যান), তখনও একটা মুসলমান বিদ্বেষ কাজ করে। এগুলো অন্যায় তো বটেই, কিন্তু তার থেকেও বড় কথা, এগুলো শেষ বিচারে হিন্দু ছুঁৎমার্গ, যা হিন্দুধর্মকেই যুগে যুগে দুর্বল করেছে। বাঙালির থেকে যদি উড়িষ্যাকে জয়দেবের অমর কাব্য নিতে হয়, হিন্দুকে যদি জন্মসূত্রে মুসলমান হরিদাসের কাছ হরিভক্তি শিখতে হয়, সে তো আনন্দের, সে তো আহ্লাদের কথা, এই প্রসারণের মধ্যে দিয়েই তো মানব-সভ্যতা প্রাচীন কাল থেকে এগিয়ে চলেছে, এভাবেই তো বাঙালির দেশজ ধর্ম সমস্ত বিজাতীয় আগ্রাসনকে হারিয়ে দেয়।
কিন্তু না, এগুলো এদের বোঝানো যাবে না, কাজেই হরিদাস মুসলমান হতেই পারেন না। তাকে ব্রাহ্মণ বানাতেই হবে। আর এভাবেই জয়দেব ও চৈতন্যকে না-বাঙালি প্রমাণ করে, আদতে উড়িষ্যাবাসী প্রমাণ করে মাধব পট্টনায়ক সেযুগের একটা শক্তিশালী উড়ে লবির বাঙালি-বিদ্বেষের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন, তাদের স্তোক দিতে চেয়েছিলেন। শেষ বিচারে, এটা হিন্দুত্ববাদের জঘন্যতম অংশগুলোর অন্যতম। অপর (আদার)কে এই নির্বোধ একবগগা বিদ্বেষ ও ঘৃণা থেকে হিন্দুধর্মের যত অপকার হয়েছে, এতটা কোনও বহিরাগত শক্তির আক্রমণেও হয়নি। সর্বোপরি, যে পাণ্ডাতন্ত্র যবন হরিদাসের সঙ্গে আগ্রাসী মুসলমানের ফারাক করতে পারে না, যে পাণ্ডাতন্ত্র কালাচাঁদ রায়কে কালাপাহাড় বানিয়ে দেয়, যারা সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে ভক্তিধর্মে দীক্ষা দেওয়ার সামাজিক গুরুত্ব বোঝে না, সেই পাণ্ডাতন্ত্রের থেকে বড় শত্রু হিন্দুধর্মের আর নেই, এ কথা মুক্তকণ্ঠে বলা দরকার।
গণ-আন্দোলনের গুরুত্ব চৈতন্যরা জানতেন, পাণ্ডাতন্ত্র বুঝত না। হিন্দুসমাজের সংস্কারের পথিক চৈতন্য নিত্যানন্দ প্রমুখ, যাঁরা জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে এক প্রেমধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন, সেযুগের বদ্ধ হিন্দুসমাজে এক বিপ্লব এনেছিলেন, এবং এই মূর্খ, ক্ষমতালোভী পাণ্ডারা, যাদেরকে আজকের হিন্দুত্ববাদেরই পূর্বসূরী বলা যায়, সেই চৈতন্যকেই মেরে ফেলল, সেই চৈতন্যকেই মুসলমান শাসকের গুপ্তচর ভাবল। এ অত্যন্ত স্বাভাবিক ট্র্যাজেডি, এরকমই হওয়ার ছিল। হিন্দুসমাজের ভেতরে যে পচন ধরেছিল, সেই পচন, সেই পুঁজরক্তময় ঘা একদিন চৈতন্যস্বরূপ ঔষধিকেই বিষ বলে প্রচার করতে শুরু করল।
চৈতন্যপন্থা ছিল বাঙালির সহজাত সহজিয়া প্রেমসাধনা। এর সঙ্গে কনট্র্যাস্ট করুন উড়ে অ্যাপ্রোচের, যার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সেই পংক্তির ভালো মিল আছেঃ দ্বার বন্ধ করে দিয়ে ভ্রমটাকে রুখি, সত্য বলে আমি তবে কোথা দিয়ে ঢুকি। এদের মনের দরজা বন্ধ, এরা অপরের ভালোটা বরং পারলে চুরি করে হাতিয়ে নেবেন, তবুও কদাপি অপরকে ভালো বলে স্বীকার করবেন না।
আলোচনা চলবে।
সঙ্গের ছবিটি বৈষ্ণবশ্রেষ্ঠ যবন হরিদাসকে বাইশ বাজারে বেত্রাঘাতের বর্ণনা করছে। পুরীতে যবন হরিদাসের সমাধি মঠে এই ছবিটি রাখা আছে।
                                                                             ****



ষষ্ঠ পর্ব
আমরা দেখছি, চৈতন্য বাংলার সেই আবহমান প্রেমধর্মের প্রতিনিধি, যার ডকুমেন্টেড ইতিহাস আমরা ধর্মপাল দেবপালের আমলে দেখেছি, বাঙালি যোগীপাল ভোগীপাল মহীপালের সঙ্গীতে যে ভালবাসার সময়কে ধরে রেখেছিল। চৈতন্য অবশ্য বৌদ্ধবিরোধী ছিলেন, তবে সে তো যুগধর্মের প্রকাশ, সেযুগে বৌদ্ধবিরোধিতা অত্যন্ত সাধারণ ব্যাপার। কিন্তু চৈতন্যধর্মের শেকড় যেখানে, সেখানে বৌদ্ধ সহজযানের নির্যাস পরমসযত্নে ধরে রাখা আছে। সেখানে ব্রাহ্মণ আর অব্রাহ্মণের ছুঁৎমার্গ নেই। চৈতন্য যে শুধু হরিদাসের মত যবনকে বুকে টেনে নিয়েছেন তাই নয়, তিনি হোসেন শাহের রাজ-প্রশাসন ও সৈন্যদলের কর্তা দবীর খাস ও সাকর মালিককে রূপ সনাতনে রূপান্তরিত করছেন। মালীবুড়ো বলছেন যে হোসেন শাহ রূপ ও সনাতনের দলত্যাগের পরে গৌড় থেকে উড়িষ্যার দিকে আর একটাও আগ্রাসন চালাতে পারেন নি, তার রাজ্যপাট কানা হয়ে গিয়েছিল। স্মর্তব্য, রূপ সনাতন যখন মুসলমান শাসকের চাকরি করতেন, ওঁরা নিজেরাই আচার ব্যবহারে প্রায় মুসলমান হয়ে গিয়েছিলেন। অনেক গবেষক বলেন যে ওঁরা প্রকৃতপক্ষে ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলমানই হয়েছিলেন, আর সেজন্যই পুরীতে এলে ওঁরা যবন হরিদাসের আশ্রয়েই বাস করতেন, অন্যত্র ওঁদের ঠাঁই মিলত না। প্রসঙ্গত বলি, বৈষ্ণবশ্রেষ্ঠ যবন হরিদাসকে কোনওদিন জগন্নাথ মন্দিরে ঢুকতে দেয় নি পাণ্ডারা।
রূপ সনাতনকে যিনি গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মের উদার পক্ষপুটে আশ্রয় দিলেন, ঘরে ফেরালেন, তাঁর থেকে হিন্দুধর্মের বড় বন্ধু আর কে? সেই চৈতন্যকে যারা মুসলমান শাসকের আগ্রাসনের সহায়ক আখ্যা দিয়ে হত্যা করল, সেই পাণ্ডাতন্ত্রের থেকে হিন্দুধর্মের বড় শত্রু আর কে? বস্তুত হোসেন শাহের গুপ্তচর যদি কেউ থেকে থাকে, তো এই লোভী আত্মপরায়ণ পাণ্ডাদের মধ্যেই সেটা থাকার প্রভূত সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। প্রমাণের অভাবে এ বিষয়ে অধিক আলোচনা করতে পারছি না। কিন্তু যুক্তি বলছে, থাকা খুবই সম্ভব।
বাংলা ত্যাগ করে নীলাচলে কেন এসেছিলেন চৈতন্য মহাপ্রভু, আমরা জানি। গৌড়ে থাকলে তাঁর প্রাণসংশয় হত। নবদ্বীপে ব্রাহ্মণ রাজা হবে, এই প্রবাদ চালু আছে শুনে গৌড়ের মুসলমান শাসক হোসেন শাহ নবদ্বীপে যে মারাত্মক অত্যাচার শুরু করেছিলেন, সে স্মৃতি তখনও টাটকা। চৈতন্যর ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তায় হিন্দুবিদ্বেষী শাসকের সন্দেহ পুনরায় জাগ্রত হতে পারত বলে তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হয় নীলাচলে। অনেক আগে বাসুদেব সার্বভৌমও সম্ভবত একই রকম আশঙ্কায় নীলাচলে চলে গিয়েছিলেন।
এইবার চৈতন্য নীলাচলে পৌঁছলে গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের নেতা চৈতন্যর সঙ্গে মহাপ্রতিপত্তিশালী বাসুদেব সার্বভৌমের যোগাযোগ ঘটান সার্বভৌমেরই ভগ্নীপতি, চৈতন্য অনুরাগী গোপীনাথ আচার্য, যিনি নবদ্বীপের বাসিন্দা, এবং চৈতন্যের নীলাচল আগমনের সময়ে সেখানে ছিলেন (যেটা পূর্বনির্ধারিত পরিকল্পনা হওয়ার অত্যন্ত সম্ভাবনা)। উপরন্তু, সার্বভৌম এসে সঠিক সময়ে না বাঁচালে চৈতন্যদেবের প্রাণসংশয় হত জগন্নাথ মন্দিরে প্রবেশের প্রথমদিনই। পাণ্ডারা তাঁকে “মার মার” শব্দে খুন করতে উদ্যত হয়েছিল, সে প্রমাণ আমরা শিশির ঘোষের অমিয় নিমাই চরিতে পাই।
                                                                             ****

সপ্তম পর্ব
জয়দেব মুখোপাধ্যায়ের উপন্যাসের শুরুতে ইতিহাসবিদ নীহাররঞ্জন রায়ের একটা চিঠির কথা বলা হচ্ছে, সেই চিঠির কথা চৈতন্য হত্যা নিয়ে আলোচনার শুরুতেই বলেছি।
“পুরীগামী জগন্নাথ এক্সপ্রেসের প্রথমশ্রেণীর কামরার চারটি বার্থের একটিতে শুয়ে আনন্দ কেবল চিন্তার আগুনে দগ্ধই হয়ে চলছিল ঘণ্টার পর ঘণ্টা। বার বার মনে পড়ে যাচ্ছিল তার ডঃ নীহার রঞ্জন রায়ের লেখা পত্রের সেই সাংঘাতিক রোমহর্ষক কথাগুলি। ৫।৮।৭৬ তারিখের দীর্ঘ পত্রের এক জায়গায় বেশ জোরের সঙ্গেই লিখেছেন তিনি - 'শ্রীমন্মহাপ্রভু চৈতন্যদেবকে গুম খুন্‌ করা হয়েছিল পুরীতেই এবং সন্ন্যাসী চৈতন্যদেবের দেহের কোন অবশেষের চিহ্নও রাখা হয় নি কোথাও। এবং তা হয়নি বলেই তিনটি কিম্বদন্তী প্রচারের প্রয়োজনও হয়েছিল। … ঐ গুম্‌খুনের সমস্ত ব্যাপারটাই একটা বহুদিন চিন্তিত, বহুজন সমর্থিত চক্রান্তের ফল। কে বা কারা এই চক্রান্ত করেছিলেন আমার অনুমান একটা আছে, কিন্তু তা বলতে পারব না। কারণ এখনও আরও কিছুদিন বেঁচে থাকতে চাই।”
আশ্চর্য! নীহাররঞ্জনের এই চিঠি যদি সত্যি হয় (মিথ্যা বলে ভাবার কোনও সঙ্গত কারণ নেই, কারণ নীহাররঞ্জনের মৃত্যুর পরে এই মর্মে দেশ পত্রিকায় ১৯৯০ সালে প্রকাশিত একটা প্রবন্ধের রেফারেন্স মৃত্যুঞ্জয় মণ্ডলের বইতে পাচ্ছি, যেখানে চৈতন্য হত্যার কথা নীহাররঞ্জন পুনরায় বলছেন। উল্লেখ্য নীহাররঞ্জনের মৃত্যু ১৯৮১ সালে), তাহলে জয়দেব মুখোপাধ্যায় প্রাণ দিয়ে সেই আশঙ্কার যথার্থতা প্রমাণ করে দিয়ে গেছেন। তাঁর হত্যাকাণ্ড নিয়ে লেখা প্রবন্ধটি আমাদের আলোচনার শেষে তথ্যসূত্রে দেওয়া লিঙ্কে গেলে পড়তে পারবেন।
পুরীর কথা বইটির টীকা আমাদের বলছেঃ
“পরবর্তী যুগের বহু গবেষক মহাপ্রভুর অন্তর্ধান খোলা মনে মেনে নিতে পারেন নি। তাঁরা সন্দেহ করেছেন বিভিন্ন কারণে, শ্রীচৈতন্যের প্রতি ঈর্ষায় তাঁকে গোপনে হত্যা করে মৃতদেহ গুম করে দেওয়া হয়। এঁদের কারো বক্তব্য জগন্নাথ মন্দিরের কোইলি বৈকুণ্ঠে, যেখানে দারুব্রহ্মের পুরোনো মূর্তি সমাধিস্থ করা হয়, সেখানেই মহাপ্রভুর দেহ মাটির নিচে পুঁতে ফেলা হয়েছে। চৈতন্যদেবকে হত্যার কারণ হিসেবে এরা উড়িয়া ও গৌড়ীয়দের বিবাদ বা চৈতন্যদেবের প্রভাবে ধর্মমুখি (sic) হয়ে রাজা প্রতাপরুদ্রদেব বা মন্ত্রী রায় রামানন্দ প্রভৃতির রাজকার্যে অবহেলা এবং ফলে কলিঙ্গ রাজ্যে বহিঃশত্রুর আক্রমণ এবং সীমানা হ্রাস রোধ করতে চাওয়ার রাজনৈতিক কারণ প্রভৃতির কথা বলে থাকেন।”
এই সময় প্রতাপরুদ্রের রাজ্যে আগ্রাসন শুধু গৌড়ের মুসলমান শাসক করছিলেন না। বিজয়নগর সাম্রাজ্য থেকেও কৃষ্ণদেবরায়ের নেতৃত্বে আক্রমণ আসছিল অনবরত (যা এক অখণ্ড হিন্দুত্বের মিথের অন্তঃসারশূন্যতাকেই প্রকাশ করে), সেগুলো প্রতিহত করা যাচ্ছিল না। চৈতন্য আন্দোলনের ফলে উড়িষ্যা দুর্বল হয়নি, সেটার অনেক প্রমাণ আছে, আলোচনার শুরুতেই বলেছি। কিন্তু চৈতন্যবিরোধী, বাঙালিবিরোধী শক্তি চৈতন্য আন্দোলন ও উড়িষ্যার সামরিক বিপর্যয়, এ দুটোকে এক করে দেখাতে সক্রিয় ছিল। চৈতন্য শেষদিকে গৌড়ীয় ভক্তদের সঙ্গেই শুধু স্বচ্ছন্দ থাকতেন, তাঁরা নীলাচল থেকে চলে গেলেই তাঁর মধ্যে অস্থিরতা দেখা দিত, যাকে জীবনীকাররা কৃষ্ণবিরহের আকুলতা বলে বর্ণনা করতে চেয়েছেন। এ আসলে চূড়ান্ত প্রতিকূল পরিস্থিতিতে বৈষ্ণব আন্দোলনের পুরোধার অসহায়তা।
যবন হরিদাস এইসময়ে অনশনে প্রাণত্যাগ করেছিলেন। সম্ভবত এই সময়ে যবন হরিদাসকে কেন্দ্র করেও চৈতন্যবিরোধী চক্র অপপ্রচার চালাচ্ছিল (এরকম একটা সন্দেহ তুহিন মুখোপাধ্যায় করছেন), এবং চৈতন্যদেবকে তাঁর জন্য কুৎসার শিকার হতে হচ্ছে, এই দুঃখে সম্ভবত অশীতিপর বৃদ্ধ হরিদাস (১৪৫০ খ্রীষ্টাব্দে তাঁর জন্ম) গৌড়ীয় ভক্তরা চলে যাওয়ার পরেই প্রাণত্যাগ করেন। এই মৃত্যুর পেছনে ষড়যন্ত্র ছিল কি না, সেটা কেউ খতিয়ে দেখেন নি এখনও পর্যন্ত। চৈতন্যদেব মারা যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর অন্তরঙ্গ পরিকরদের অন্তর্ধানকে গবেষকরা মোটামুটি সবাই চৈতন্য হত্যার ষড়যন্ত্রের অঙ্গ হিসেবেই দেখেন। এমন কি হতে পারে, হরিদাসের মৃত্যু দিয়েই সেই ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছিল?
                                                                            ****




অষ্টম পর্ব
অদ্বৈত আচার্যের সেই বিখ্যাত হেঁয়ালি কি চৈতন্যের প্রতি একটা সতর্কবাণী ছিল? শিশিরকুমার ঘোষ প্রণীত শ্রী অমিয় নিমাই চরিত থেকে উদ্ধৃত করছি।
জগদানন্দ শ্রীনবদ্বীপ ত্যাগ করিয়া নীলাচল অভিমুখে যাইতে অদ্বৈতের নিকটে চলিলেন। সেখান হইতে বিদায় হইয়া মহাপ্রভুর নিকটে আসিলেন। ঠাকুরকে প্রণাম করিয়া শ্রীনবদ্বীপের ভক্তগণের সংবাদ সমুদায় বলিলেন। তাহার পরে বলিতেছেন, “শ্রীঅদ্বৈতপ্রভু আপনাকে একটি তরজা বলিয়া পাঠাইয়াছেন, সে তরজাটি এই -
প্রভুকে কহিও আমার কোটি নমস্কার।
এই নিবেদন তাঁর চরণে আমার।।
“বাউলকে কহিও লোকে হইল আউল।
বাউলকে কহিও হাটে না বিকায় চাউল।।
বাউলকে কহিও কাজে নাহিক আউল।
বাউলকে কহিও ইহা কহিয়াছে বাউল।।”"

মৃত্যুঞ্জয় মণ্ডল বলছেন যে এই চর্যা শোনার পর থেকে চৈতন্যদেবের মধ্যে বিরহযন্ত্রণা বেড়ে গেছিল, এবং ঘন ঘন বাহ্যজ্ঞানলুপ্ত হতে শুরু করেন তিনি, প্রলাপ বকতেও শুরু করেছিলেন। বিভিন্ন জীবনী থেকে জানা যায়, চৈতন্যকে বিষাদে গ্রাস করেছিল। তিনি গৌড়ে আর ফিরতে পারবেন না, রূপ সনাতনকে হোসেন শাহের দল থেকে ভাঙিয়ে আনার পরে সেটা তো আর সম্ভব নয়, ফিরলেই প্রাণসংশয়। অদ্বৈতের এই ছড়ায় সম্ভবত উৎকলের অবস্থা সম্পর্কে চৈতন্যকে সতর্ক করা হয়েছে, প্রেমধর্মের চাউল আর হাটে বিক্রি করতে দেওয়া হচ্ছে না, এবং এসময়ে উড়িষ্যায় বসে বৈষ্ণবধর্মের প্রচারে কাজ নেই, বিপদ হতে পারে। অর্থাৎ এখানে চৈতন্যবিরোধী, বাঙালিবিরোধী ষড়যন্ত্রের কালো মেঘ ঘনিয়ে আসার সাঙ্কেতিক বার্তা দেওয়া হয়েছে। মহাপ্রভুকে এই সময়ে বৃন্দাবন নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা ও যোগাড়যন্ত্রও শুরু করেছিলেন গৌড়ীয় বৈষ্ণবেরা, বৃন্দাবনে তাঁর জন্য বাসস্থানও নির্দিষ্ট হয়েছিল। সে পরিকল্পনা সফল হয়নি। সার্বভৌম কিন্তু দেখতে পাচ্ছি নীলাচল ত্যাগ করে কাশীধামে চলে যাচ্ছেন।
মৃত্যুঞ্জয় উল্লেখ করছেন, অদ্বৈতের এই সাঙ্কেতিক বার্তা আসার পরে বেশিদিন চৈতন্য বাঁচেন নি। এই সাঙ্কেতিক বার্তার অর্থ অবশ্য এটাও হতে পারে, যে বৈষ্ণব আন্দোলন সিদ্ধিলাভ করেছে, লোকের ভাণ্ডার পূর্ণ হয়েছে, অতএব মহাপ্রভু এইবার ভবলীলা সাঙ্গ করতে পারেন, কিন্তু বৈষ্ণব আন্দোলনের তখনকার গতিপ্রকৃতি স্টাডি করলে দেখা যায়, সে অর্থটি একেবারেই লাগসই নয়। মৃত্যুঞ্জয় আবার মনে করেছেন যে এই বার্তায় অদ্বৈতর দলের সঙ্গে নিত্যানন্দের দলের বিরোধের আভাস আছে, তবে সেটা একেবারেই যুক্তিযুক্ত সিদ্ধান্ত নয় বলে আমি মনে করি।
দীনেশ সেনই বাঙালি চিন্তাবিদদের মধ্যে প্রথম প্রকাশ্যে বলেন যে চৈতন্যকে হত্যা করে হয়েছিল। ইংরেজিতে লেখা চৈতন্য অ্যান্ড হিজ এজ বইতে তিনি বিষয়টি তুলেছিলেন, এবং মন্দিরের দরজা বন্ধ করে চৈতন্যর মৃতদেহ মন্দিরের মধ্যেই পুঁতে দেওয়ার কথা জানিয়েছেন। রাজার অনুমতি ছাড়া এই কাজ হত না, কিন্তু রাজার পক্ষে চৈতন্যহত্যার ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার অভিযোগ আনতে ইতস্তত করেছেন দীনেশঃ “They buried him somewhere under the floor of the temple and would not allow any outsider to enter it until the place was thoroughly repaired and no trace left after his burial as I have already stated. This is the only rational explanation that may be advanced for explaining their conduct in shutting the temple gate. Probably they did so with the permission of Raja Pratap Rudra. But I think I go too far in suggesting that monarch's conniving at their conduct”
এইপ্রসঙ্গে দীনেশ সেন বৃহৎ বঙ্গে বলছেনঃ
“সেদিন অপরাপর দিনের ন্যায় বেলা তিনটার সময় গুণ্ডিচা বাটীর দরজা খোলা হয় নাই। চৈতন্যর পার্শ্বচরগণ মন্দিরের দ্বারে ভিড় করিয়া ছিলেন। কিন্তু আটটা রাত্রিতে দরজা খুলিয়া পাণ্ডারা বলেন – মহাপ্রভু স্বর্গে গমন করিয়াছেন, তাঁহার দেহের আর কোন চিহ্ন নাই। বেলা তিনটা হইতে রাত্রি আটটা পর্য্যন্ত সেই গৃহে পাণ্ডারা খিল লাগাইয়া কি করিয়াছিলেন? ... মন্দিরের মধ্যেই দেববিগ্রহের প্রকোষ্ঠ-সংলগ্ন বৃহৎ মণ্ডপের এককোণে তাঁহাকে সমাধি দেওয়া হয়। প্রতাপরুদ্রের অনুমতি লইয়াই সম্ভবত ঐরূপ করা হইয়াছিল, যেহেতু উক্ত পুস্তকের একখানিতে লিখিত হইয়াছে, বহু পুষ্পমাল্য সেই মন্দিরের গুপ্তদ্বার দিয়া তখন লইয়া যাওয়া হইয়াছিল। ... পুরীর পাণ্ডাদের মধ্যে আর একটি ভীষণ প্রবাদ প্রচলিত আছে - তাহা আমি তথায় শুনিয়াছি। জগন্নাথ বিগ্রহ হইতেও চৈতন্যের প্রতিপত্তি বেশি হওয়াতে পাণ্ডারা নাকি গোপনে তাঁহাকে হত্যা করিয়াছিল।”

চৈতন্যকে সচল জগন্নাথ বলা হত, এবং চৈতন্যের প্রভাবের সামনে পাণ্ডাদের কায়েমী স্বার্থ নিঃসন্দেহে বারবার ধাক্কা খাচ্ছিল। হতেই পারে যে এজন্যই প্রতাপরুদ্রের সামরিক পরাজয়ের জন্য চৈতন্য আন্দোলনকে দায়ী করার চেষ্টা হয়। চৈতন্য বহুবার দুষ্টের দমনে বলপ্রয়োগের কথা বলে গেছেন, নবদ্বীপে কাজীদলনের এপিসোডে সেই বাহুবলের স্ফুরণ আমরা দেখতে পাই। চৈতন্য আন্দোলন ভক্তির মাধ্যমে গণ আন্দোলন, অহিংসা তার মূল বাণী নয়, সামান্য কোড অভ কনডাক্ট মাত্র, এই আন্দোলনের মূল বাণী মানুষে মানুষে সাম্য, এবং হিন্দুসমাজের পুনরুজ্জীবণ। ভক্তদ্রোহীকে কড়া দৈহিক শাস্তির বিধান চৈতন্য দিয়েছেন, এবং একাধিকবার নিজেও বলপ্রয়োগ করেছেন।
কিন্তু শেষের দিকে পাণ্ডাচক্রের অনবরত বিরুদ্ধতা, ষড়যন্ত্র ও অপপ্রচারে চৈতন্য কি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন? একাধিক বিবরণ থেকে তাই মনে হয়, যেটাকে ভক্তেরা কৃষ্ণবিরহে বিপর্যস্ত অবস্থা বলেছেন।
চৈতন্যের তিরোধানের পরে গৌড়ীয় বৈষ্ণব আন্দোলনের দশা নিয়ে দীনেশ সেন লিখছেনঃ
“চৈতন্যের তিরোধান-সম্বন্ধে প্রসিদ্ধ গ্রন্থগুলি সকলেই নীরব। যে কয়েকখানি পুস্তকে একটু ইঙ্গিত আছে, তাহা বৈষ্ণব সমাজের সর্ব্বজনাদৃত গ্রন্থ নহে। শুধু লোচনদাস একশ্রেণীর বৈষ্ণবদের মধ্যে লব্ধপ্রতিষ্ঠ, তাঁহার পুস্তকেও এ সম্বন্ধে সামান্য কয়েকটি কথা আছে। যে কারণেই হউক, এই নীরবতা দুঃসহ শোকজ্ঞাপক। ভগবান্‌ ধুতি চাদর পরিয়া বাঙ্গালী সাজিয়া বাঙ্গালীর মধ্যে লীলা করিয়া গিয়াছেন, এত বড় গৌরবে এদেশের লোকেরা গৌরবান্বিত ছিল, চৈতন্যের তিরোধানে সেই জাতীয় গৌরব-কিরীট শিরশ্চ্যুত হইল। জাহাজ ডুবিয়া ভাঙ্গিয়া চুরিয়া গেলে যেরূপ তাহার ভগ্ন অংশগুলি অর্ণবে ইতস্ততঃ দৃষ্ট হয় – এই মহাবিপদের দিনে বৈষ্ণব সমাজ তেমনই বিচ্ছিন্ন ও ছত্রভঙ্গ হইয়া পড়িল। গঙ্গাতীরে যে মহাকীর্ত্তনের দল মন্দিরা, করতাল, ডম্ফ ও মৃদঙ্গনিনাদে আকাশ দিবারাত্র প্রতিশব্দিত করিত, হঠাৎ সেই আনন্দোৎসব থামিয়া গেল। অদ্বৈত, নিত্যানন্দ, শ্রীবাস ও নরহরি ধীরে ধীরে শোকসন্তপ্ত হইয়া অব্যক্ত দুঃখে মৃত্যুমুখে পতিত হইলেন। … সনাতন এবং তাঁহার ভারতপ্রসিদ্ধ ভ্রাতা রূপ গোস্বামী চৈতন্যের তিরোধান শুনিয়া তাঁহার সর্ব্বজনবন্দিত চরণ ধ্যান করিয়া ধীরে ধীরে মৃত্যুমুখে পতিত হইলেন। ১৫৩৩ খৃঃ অব্দের পর গৌড়ীয় বৈষ্ণব-সমাজের কাজ প্রায় অর্ধশতাব্দী বন্ধ ছিল। মহাশোকে মতিচ্ছন্ন চৈতন্যের অনুচরগণ যেন বজ্রাঘাতে চেষ্টাহীন ও নীরব হইয়াছিলেন” (বৃহৎ বঙ্গ )।
স্বরূপ দামোদর, চৈতন্যের অন্তরঙ্গ পরিকর চৈতন্যহত্যার অব্যবহিত পরেই নিহত হন পুরীতে। তাঁর বুক ফেটে প্রাণ বেরিয়ে যাওয়ার কথা যেটা বলা হয়, মালীবুড়ো বলছেন যে ওটা কুঠার বা ওরকম কোনও ধারালো অস্ত্র দিয়ে তার বুকে আঘাতের ফল। আরেক চৈতন্য অন্তরঙ্গ গদাধরেরও মন্দিরের ভেতরে অন্তর্ধান ঘটে, মালীবুড়ো বৃন্দাবন দাসের পুঁথি থেকে উদ্ধৃত করে জানাচ্ছেন।
চৈতন্য সাতচল্লিশ বছর বেঁচেছিলেন। ১৪৮৬ সালে জন্ম, ১৫৩৩ সালে তাঁকে হত্যা করা হয়। এই সংক্ষিপ্ত সময়ে তিনি যে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন, যে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন, যে সমাজসংস্কার, ধর্মসংস্কার করে গেছেন, বারবার সেসব অধ্যয়ন করতে হবে। এবং তাঁর মৃত্যু থেকেও শিক্ষা নিতে হবে। পাণ্ডাদের হাতে চৈতন্যর হত্যা শিক্ষা দেয়, পাণ্ডাতন্ত্রের গোঁড়ামি ও সঙ্কীর্ণ হিন্দুত্ববাদ হিন্দুসমাজের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর, এমনকি প্রায়ই তা ইসলামের আগ্রাসনের থেকেও বেশি ক্ষতিকর হতে পারে। চৈতন্যর হত্যা আমাদের এও শেখায় যে আমাদের একদল প্রতিবেশী বাঙালির প্রতি বিদ্বেষে উন্মত্ত হয়ে অত্যন্ত কুৎসিত কাজেও লিপ্ত হতে দ্বিধা বোধ করে না।
চৈতন্যকে আমাদের জাতির সহস্র সহস্র বছরের তারকাখচিত ইতিহাসে শ্রেষ্ঠতম বাঙালি বলে ভাবতেই পারি আমরা। তাঁর হত্যার উপযুক্ত অনুসন্ধান হোক, ঐতিহাসিক গবেষণা চলুক, সম্পূর্ণ সত্য সামনে আসুক, দোষীরা জনসমক্ষে উন্মোচিত হোক, বাঙালি হিসেবে এই দাবী তোলা আমাদের অবশ্যকর্তব্য।
(সমাপ্ত)

মন্তব্যসমূহ

  1. Onek bishoye abogato holaam...kintu monnvarakranta holo....tobu boli hotta rahosya udghatito hok eyi kamon....onek dhonya bad abogato korar jony....aro jante chai.

    উত্তরমুছুন
  2. এই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।

    উত্তরমুছুন
  3. কিছু কিছু পড়েছিলাম। এত বিস্তারিত ভাবে এই প্রথম।

    উত্তরমুছুন
  4. Joydeb Mukhopadhyay er ghotona shombondhye link dewar kotha likhechen, kintu probondher seshe khunje pelam na..

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. হ্যাঁ সত্যিই । লিংক পেলাম না ।

      মুছুন
    2. https://boibaree.blogspot.com এ জয়দেব মুখোপাধ্যায়ের সবকটি বই'এর লিঙ্ক পাবেন।

      মুছুন
  5. আশা ক'রি চৈতন্য-গবেষণায় এই নিবন্ধটি আগ্রহ বাড়াবে।

    উত্তরমুছুন
  6. আপনার লেখা পড়ে আমার মাথায় ও মনি দাও দাও করে আগুন ধরেছে

    উত্তরমুছুন
  7. ধন্যবাদ দাদা।শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর জীবনের অনেক অজানা তথ্য পেলাম এবং একই সাথে তাঁর জীবন ও কর্ম সম্পর্কে আরও জানার প্রত্যয় জন্ম নিল।

    উত্তরমুছুন
  8. দুর্দান্ত তথ্য বহুল বিশ্লেষণ। বেশ আয়াসসাধ্য কর্মটির জন্য আন্তরিক সাধুবাদ জানাই। আমার পরম শ্রদ্ধেয় শিক্ষক প্রফেসর লায়েক আলি খান মহাশয়ের কাছে বিভিন্ন প্রসঙ্গে 'চৈতন্য হত্যা'র ঋদ্ধ বিশ্লেষণ শুনেছি। বঙ্গীয় সাহিত্য পর্ষদ প্রকাশিত তাঁর 'প্রসঙ্গ :বৈষ্ণব সাহিত্য ' গ্রন্থের শেষাংশে এ বিষয়ে দীর্ঘ মনোজ্ঞ আলোচনা আছে।

    উত্তরমুছুন
  9. হত্যার ব্যাপারটি সন্দেহে ছিল,তবে এত তথ্যের পুরোটাই অজানা ছিল।অসংখ্য ধন্যবাদ লেখককে।আপনার লেখনীর প্রতি আগ্রহ বেড়ে গেল।চৈতন্যদেব প্রসঙ্গে আপনার আর কোন লেখনী আছে কি?পড়ার আগ্রহ প্রকাশ করছি।সম্ভব হলে লিঙ্ক পাঠাবেন।কৃতার্থ বোধ করব।

    উত্তরমুছুন
  10. Nimai er mrityu nisondehe sondehojonok. Tobe ami ektu onyo byapare kotha bolchhi - jodi hindu dhormer gorami hindu dhormer pokkhe khotikarok hoy tobe muslim dhormer gorami muslim dhormer pokkhe khotikarok hoy na kano ?

    উত্তরমুছুন
  11. Kromagoto orissar manushder babgali birodhi bole setakei chaitanya hotya r karon bola hoyechhe. Tobe srichaitanya ke bangla chhere jete hoyechhilo kano ? Sekhane to bangali ra e chhilo jara tnake banciue rakhte parto. Tobe tnake baranasi ba brindabon jabar kotha bhabte holo kano ? Nijer deah thakte srichaitanya ke baranasi ba brindaban jete hobe kano ? Tobe ar sudhu sudhu bangali bidwesher opobad deoa kano ? Juge juge bhalo manush der mere fela hoyechhe. Subhas chandra ke o to mere fela hoyechhe.

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. নিজের দেশ কেন ছেড়ে উড়েদের দেশে গিয়েছিলেন সেটা আলোচনা করা হয়েছে। পুনরুক্তি নিষ্প্রয়োজ।
      দ্বিতীয়ত, ভালো মানুষ মেরে ফেলার গোলগোল ব্যাপার নয়। বিশ্বমানবতার আরামদায়ক বুদবুদ থেকে বার হয়ে আসুন। বাঙালিবিদ্বেষ উড়িয়াদের জাতিগত সংস্কৃতির একটি। সেটা চিহ্নিত করুন।

      মুছুন
  12. Acchha Hussain shah jodi atoi rege thaken tahole to tini o lok lagiye mere felte paren. Abar bangali e to bangalir prodhan sotru , hussain shah er bangali hindu secular sangopango ra o to onake mere felte pare. Swami Vivekananda ke o to hotya kora hoyechhilo. Bola hoy tarao oi secular e chhilo.

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. স্বামী বিবেকানন্দকে হত্যা করা হয়েছিল এই তথ্য আপনি কোথা থেকে পেলেন? কোন ঐতিহাসিক বিষয়ের উপর বিতর্কে অংশ নিতে হলে যে ন্যুন্যতম জ্ঞ্যানের দরকার সেটা আপনার নেই,উপরন্তু দায়িত্বজ্ঞ্যানও নেই। দয়া করে ভুল তথ্য দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করবেন না।

      মুছুন
  13. ড দেবব্রত দাসের লেখাতে সার্বভৌম কন্যার উল্লেখ আছে যিনি শাটীদেবী নামে পরিচিত।

    উত্তরমুছুন
  14. আমি একটা কথা জিজ্ঞেস করবো ,স্বয়ং প্রতাপরুদ্র দেব যাঁর পরম ভক্ত ছিলেন ..যাঁর ভক্ত ছিলেন জগন্নাথ দেবের দেহরক্ষী অনন্ত প্রতিহারী... যাঁর দুজন দেহরক্ষী কাশিশ্বর ও গোবিন্দ সবসময় তাঁর সাথে ছায়ার মতো থাকতো... কানাই খুঁটিয়া জগন্নাথ মন্দিরের অন্যতম সেবায়েত... সেও চৈতন্য ঘনিষ্ঠ... কাশী মিশ্র ছিলেন মন্দিরের প্রশাসনিক কর্তা... ইনিও চৈতন্য দেবকে দেবতা মনে করতেন...এবং আরও অনেকেই আছেন...তাহলে এতো জনকে এড়িয়ে চৈতন্য দেবকে হত্যা করা কি সম্ভব?
    আর পাণ্ডাদের কথায় যদি বলেন তাহলে বলবো যে চৈতন্য দেবের জন্যে জগন্নাথ মন্দিরে এতো লোক সমাগম শুরু হয়েছিল...এতে পাণ্ডাদের অনেক রোজগার হতো...আর চৈতন্য দেব পাণ্ডাদের কোন কাজে হস্তক্ষেপ করেন নি...তাহলে পান্ডার হত্যা কেন করবে?

    একটু ভেবে দেখবেন...

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. আসলে লেখাটির কোনো ভিত্তি নেই... ইংরেজদের সময় থেকে বাঙালিরা ওড়িশায় সমস্ত পরোক্ষভাবে ক্ষমতা উপভোগ করেছে... ওড়িয়াদের সুযোগ প্রায় ছিলনা বললেই চলে... ওড়িয়া জনগণের মনে তাই চিরকাল চাপা রাগ ছিল... তবে সেটা সবার নয়... কিন্তু ইংরেজ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় সম্ভ্রান্ত বাঙালিরা নিজেদের ওড়িশার ভূস্বামী ভাবতে শুরু করে... এমনকি ওড়িশায় সরকারি ভাষা হিসেবে ওড়িয়ার বদলে বাঙলা করার দাবিও ওঠে... পরে ওড়িশা ব্রিটিশ ভারতে আলাদা রাজ্যের তকমা পেলে রাতারাতি এই ভাবনায় আঘাত হয়... ওড়িয়াদের নিজের ভূমি আর সংস্কৃতির উপর অধিকার পাওয়া ওই বাঙালিদের আত্মসম্মানে আঘাত হানে... ফলস্বরূপ তারা ছড়াতে থাকে ওড়িয়াদের প্রতি বিদ্বেষ মনোভাব, তাদের নিচু চোখে দেখা ও তাদের খলনায়ক বানানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। যার ফলস্বরূপ এইসব চৈতন্যদেবকে হত্যা প্রভৃতি তত্ত্ব বেরিয়ে আসে।

      মুছুন
  15. প্রসঙ্গত ১৫১০ এর পর ২৩ বছরে আর কোনদিন চৈতন্য দেব জগন্নাথ মন্দিরে প্রবেশ করেন নি...১৫৩৩ যেদিন শেষ ওনাকে দেখা গিয়েছিল ওইদিন উনি মন্দিরের গর্ভগৃহে প্রবেশ করেন...

    উত্তরমুছুন
  16. অত্যন্ত বলিষ্ঠ প্রতিবেদন।শিক্ষণীয় 🙏

    উত্তরমুছুন
  17. তথ্যসমৃদ্ধ লেখা।
    ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় বাঙালি ব্যাক্তিত্ব হলেন আমাদের সব বাঙালীর নদের নিমাই। ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক বিভাজন রেখার বাইরে থেকেই বাঙালীরা তাঁর মূল্যায়ন করেন। তাই তাঁর জীবনের কুয়াশা ঢাকা অংশ আলোকিত করা দরকার। সেটা হলে ভক্তিবাদী আন্দোলনের মাহাত্ম্য কোনমতেই ক্ষুন্ন হবে না।

    উত্তরমুছুন
  18. একার সাথে নিত্যদিনই একারই হয় দেখা। ষড়যন্ত্রের ও অপার্থিব শক্তি আছে। জয় মহাপ্রভু।

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

শিকড়ের সন্ধানে-বেগুনিয়ার সিদ্ধেশ্বর মন্দিরেরডায়েরী; লিখেছেন শ্রী তিলক পুরকায়স্থ

শিকড়ের সন্ধানে-বেগুনিয়ার সিদ্ধেশ্বর মন্দিরের ডায়েরী। পশ্চিম বর্ধমান জেলার প্রান্ত বিন্দু বরাকর শহর, যার বহু প্রাচীন নাম বেগুনিয়া।এর পরেই শুরু দামোদর নদ এবং ঝাড়খন্ড রাজ্যের ধানবাদ জেলার।এখানে পৌঁছুতে হলে যে কোনো ট্রেন এ চেপে আসানসোল স্টেশন নেমে যান।ধর্মতলা থেকেও প্রচুর ভলভো বাস ছেড়ে আসানসোল আসে।আসানসোল থেকে বরাকর যাবার অগুনতি বাস ও মিনিবাস আছে।আবার black diamond/ coal field এক্স চাপলে, সোজা নামুন বরাকর।এখান থেকে পায়ে হেঁটে বা রিক্সা করে পাঁচ মিনিটে পৌঁছবেন গন্তব্যে। দামোদর নদের প্রায় কোল ঘেঁষে আছে এক সুপ্রাচীন-ঐতিহাসিক, নান্দনিক এবং অপরিসীম প্রত্নতাত্বিক মূল্যের মন্দিররাজি।বর্তমানে চারটি অপূর্ব সুন্দর পাথরের দেউল দাঁড়িয়ে আছে(আগে পাঁচটি ছিল), যার সমষ্টিগত নাম সিদ্ধেশ্বর মন্দির।এবং আপনাদের জ্ঞাতার্থে জানাই যে বাংলাদেশের প্রাচীনতম পাথরের দেউল হচ্ছে, এদের মধ্যে যেটি সামনের দিক থেকে শেষ বা চতুর্থ এবং ক্ষুদ্রতমটি। ওড়িশা রেখা বা শিখর রীতিতে তৈরি এই অপূর্ব সুন্দর দেউল গুলি কালের করাল গ্রাস জয় করে এখনো টিঁকে আছে।এ আমাদের পরম সৌভাগ্য।কিন্তু বাঙালি জাতির চরম ঔদাসীন্য, ঠুঁটো জগন্নাথ কতৃপক্ষ,

বাংলায় ব্রাহ্মণ

একদা এঁরা বাংলায় আসেন, রাজাদের পৃষ্ঠপোষণায় জমিজিরেত ও হরেক সুবিধা ভোগ করেন। অতঃপর আদিশূর নামে আধা-কল্পিত এক চরিত্রকে ঘিরে নিজেদের সামাজিক মর্যাদা আরও বাড়িয়ে নেন, সেই অনুযায়ী স্মৃতি, শাস্ত্র ও কুলজিগ্রন্থ রচনা করেন। ক্রমশ বৈদিক, রাঢ়ী, বারেন্দ্র, কুলীন, ভঙ্গ ইত্যাদি হরেক ভাগে বিভক্ত হয়ে যান। এঁরাই  বাঙালি ব্রাহ্মণ! কুণাল চক্রবর্তী ২৭ মে, ২০১৮, ০০:৩৪:৩৪ ব্রাহ্মণরা বাংলার আদি অধিবাসী নয়। বস্তুত দীর্ঘ দিন বাংলা ব্রাহ্মণদের প্রভাবসীমার বাইরে ছিল। বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকের নৃতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিকেরা লক্ষ করেছিলেন, ‘আর্য’রা পূর্ব ভারতে কিছুটা দেরিতে পৌঁছেছিল এবং তাদের অগ্রগতি স্থানীয় মানুষ প্রতিরোধ করেছিল। বাংলা অবশ্য শেষ পর্যন্ত ব্রাহ্মণ্য বলয়ের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল, কিন্তু প্রক্রিয়াটি খুব সহজ হয়নি। ব্রাহ্মণ্যবাদ যে ক্রমশ পূর্ব দিকে বিস্তৃত হচ্ছিল, প্রাচীন ব্রাহ্মণ্য সাহিত্যে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। অথর্ব বেদেই মগধ ও অঙ্গের প্রথম নিঃসংশয় উল্লেখ আছে। এই গ্রন্থটির মতে এ দুটি ছিল ব্রাত্যদের দেশ। বঙ্গের প্রথম দ্বিধান্বিত উল্লেখ পাই ঐতরেয় আরণ্যক গ্রন্থে