সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

দুর্গোৎসবের উৎস সন্ধানে - অব্জ কেশর কর

নানা রূপে মহিষমর্দিনীর মূর্তি: 

মহামুনি মেধা মেধসের বর্ণনানুযায়ী মহিষমর্দিনীর তিন প্রকার মূর্তি প্রচলিত।

* ১) অষ্টাদশভুজা(কাত্যায়নী)
* ২) ষোড়শ ভুজা (চন্ডী)
* ৩) দশভুজা (দুর্গা)


বঙ্গদেশে ৫০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১২০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত পাথরের মূর্তিতেই মহিষাসুরমর্দিনীর আরাধনা হয়েছে। আর এই তিনপ্রকার মূর্তিই বঙ্গদেশে পাওয়া গেছে। এই সকল মূর্তি গুলি লক্ষী, সরস্বতী, গণেশ কার্তিক অনুপস্থিত। ১২০০ খ্রিস্টাব্দের পর রাজা কংসনারায়ণ শরৎ কালে প্রথম মাটির মূর্তি গড়ে পুজোর আয়োজন করেন। তার আগে বাংলাতে মহিসমর্দিনী শুধু কুলদেবী রূপেই আরাধনা করা হতো। কংসনারায়ণই প্রথম শারদীয়া পুজো করেন। রামের গল্পটার একেবারে মিথ্যা। কংসনারায়ণ যে বছর শারদীয়া পুজো করেন সেই বছর রাজা সূর্যনারায়ণ বাসন্তী পুজো করেন। যদিও শোনা যায় রাজা সূর্যনারায়ণ নাকি রাজা সুরথের বংশধর। কথিত আছে রাজা সুরথ যিনি কিনা প্রথম দুর্গোৎসব করেন। রাজা কংসনারায়ণই সপরিবারে দুর্গাপুজোর অর্থাৎ সরস্বতী, কার্তিক, গণেশ, লক্ষী সহ দুর্গাপূজার প্রবর্তক। সেই মূর্তি ছিল একচালা। সিংহ ছিল ঘোড়ামুখী। বাকি মূর্তি গুলো ছিল কাঠের পুতুলের মত। এই মূর্তি এখন শুধুমাত্র কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতে পাওয়া যায়।কৃষ্ণনারায়ণর এই শারদীয়া পুজোকেই কৃত্তিবাস রামায়ণে নথিভুক্ত করেন বঙ্গসমাজে তার এই নতুন রামায়ণকে জনপ্রিয় করে তুলতে, বাল্মীকি রামায়ণে দুর্গাপুজোর কোনো উল্লেখ নেইরাম কস্মিনকালেও দুর্গাপুজো করেনি। তার যথেষ্ট প্রমান আমার কাছে আছে। যাই হোক সেটা আলাদা প্রসঙ্গ। তাহলে ঋতুভিত্তিক দুর্গাপুজোর ইতিহাস ৮০০-৯০০ বছরের পুরনো। রাজা কংসনারায়ণের এই শারদীয়া পুজোকেই নদীয়া রাজ-মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র জনপ্রিয় করে তোলেন। একই বছর নবকৃষ্ণদেবও শারদীয়া দুর্গোৎসব করেন। মানে ১৭৫৭ সালে। সেটাই উত্তর কলকাতার প্রথম দুর্গাপুজো। দক্ষিণ কলকাতায় শারদীয়া পূজোর ইতিহাস আরোও প্রাচীন। আমরা বর্তমানে মাটিতে গড়া দুর্গামূর্তিতে আরাধানা করি সেটা ওই কংসনারায়ণ ঘরানা বাংলায় আরোও এক ধরণের মূর্তিতে পুজোর প্রচলন রয়েছে সেটা হলো বিষ্ণুপুর ঘরানা 

বাংলায় প্রচলিত দেবী মূর্তির  দুটি  ভিন্ন শৈল্পিক ঘরানা:


বিষ্ণুপুর ঘরানা এবং কংসনারায়ণ ঘরানা উভয় ঘরানাই ৯০০ বছরের প্রাচীন এবং স্বাতন্ত্র ভাবে উদ্ভাবিত। কংসনারায়ণ বর্তমান বাংলাদেশের তাহেরপুরের রাজা। শোনা যায় সূর্যনারায়ণ রাজা সুরথেরই বংশধর। এই জায়গাটি বাংলাদেশ সরকার হেরিটেজ করেছে। প্রত্যেক বছর স্থানীয় হিন্দু জনগণের প্রচেষ্টায় ও সরকারি সাহায্যে এখানে দুর্গোৎসব হয়। তাঁর প্রাসাদের ধ্বংসস্তূপ এখনও তাহেরপুরে আছে। বাংলাদেশের হিন্দুদের দাবিতে সেটি এখন জাতীয় সম্পত্তি ঘোষিত হওয়ার চেষ্টা চলছে। এবার রাজা সুরথের প্রসঙ্গে আসি। মেধস মুনির আশ্রমে এসে রাজা দুর্গাপুজোর আদেশ পান। এই মেধসের আশ্রম বর্তমান চট্টগ্রামের চন্দ্রনাথ পাহাড়ে। এটি বাংলাদেশের হিন্দুদের বৃহত্তম তীর্থ স্থান। এই আশ্রমটি এখনও আছে। সুরথের বংশধর হলেন সূর্যনারায়ণ। তবে এর রাজপ্রাসাদ বা ভিটের কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়নি। রাজা সুরথকে নিয়ে একটি বিতর্ক আছে। বীরভূমের লোকেদের দাবি রাজা সুরথের বাসস্থান নাকি বীরভূমের বোলপুরে। রাজা সুরথ ১০০১টি পাঁঠা বলি দিয়েই প্রথম দুর্গোৎসব করেন, তাই ওই অঞ্চলের নাম বলিপুর হয়ে যায়। আর এই বলিপুর থেকেই আজকের বোলপুর নাম। এবার আসি বিষ্ণুপুর ঘরানায়। এটা কংসনারায়ণের থেকেও প্রাচীন। ৯৯৭ খ্রি মল্ল রাজারা বিষ্ণুপুরে মাতৃ মূর্তি গড়ে শারদীয়া দুর্গা পুজো করেন। এটি সম্পূর্ণভাবে রাঢ় বাংলার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। মল্লরাজারা প্রথমে শাক্ত ছিলেন। কুলদেবী মৃন্ময়ীমাতার মন্দির গড়ে উপাসনা করতেন। সেই মন্দির এখনও আছে বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরে। মল্লরাজারা চৈতন্য প্রভাবে বৈষ্ণব হয়ে গেলে ওই পুজোর জৌলুস কমে যায়।বিশুদ্ধ শাক্তাচারগুলি বৈষ্ণব প্রভাবে পরিবর্তিত হতে থাকে|
বিষ্ণুপুর ঘরানা
কংসনারায়ণ ঘরানা 

প্রাচীনত্ব খুজতে গিয়ে  


পাল আমলে ( ৭৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১১২৬ খ্রিস্টাব্দ) বাংলায় পাথরের মূর্তি নির্মাণে প্রভূত উন্নতি হয়েছিলো। পাল আমলে বেলেপাথরের মহিষাসুরমর্দিনীর মূর্তি উদ্ধার করা হয়েছে। সেটাই প্রমান করে যে পাল যুগে মহিষাসুরমর্দিনীর আরাধনা হত। আজ থেকে ১২০০ বছর আগে মহিষমর্দিনীর আরোধনা হত মূলত কুলদেবী রূপে। আজকের মত ঋতুভিত্তিক দুর্গোৎসবের প্রচলন ছিল কিনা তা স্পষ্ট নয়।
পাল আমলের মহিষমর্দিনীর মূর্তি


#প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনে রাঢ়বাংলার দুর্গা মূর্তি :

নিচের মহিষমর্দিনী মূর্তিটি এক ব্রিটিশ প্রত্নতাত্বিক অবিভক্ত মানভূম জেলা থেকে উদ্ধার করেন। এটিও পাল আমলের শেষ দিকে নির্মিত। পুরুলিয়ার এক পরিত্যক্ত মন্দির থেকে এটি উদ্ধার করা হয়। এই মূর্তিটারই প্রমান করে যে রাঢ়বাংলাতেও মহিষমর্দিনীর আরাধনা হত। পাল আমলে সমগ্র বাঙলাতেই মহিষমর্দিনীর আরাধনা হত। বিশ্লেষণ করে জানা যাচ্ছে মহিষাসুরমর্দিনীর এই মূর্তিটি ৯০০ খ্রিস্টাব্দে কাছাকাছি সময়ে নির্মিত।
মানভূম থেকে প্রাপ্ত 



ভারতীয় জাদুঘরে রক্ষিত 


টেরাকোটায়  মহিষমর্দিনী


টেরাকোটায় মহিষমর্দিনীর মূর্তি বাংলার মন্দিরের দেওয়ালে পাওয়া যায়। এই ধরনের শিল্পরীতির সর্বাধিক বিকাশ হয় চৈতন্য সমসাময়িক কালে। বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুর, কিংবা দিনাজপুরের কান্তজিউ এবং সারা বাংলায় ছড়ানো নানান টেরাকোটার মন্দিরে খোদিত পৌরাণিক কাহিনী ছাড়াও রয়েছে মহিষাসুরমর্দিনীর মূর্তি। সপরিবারে (যদিও  সপরিবারে কথাটা একেবারেই ভুল, কারণ সরস্বতী বা লক্ষ্মী কেউই দুর্গার দুহিতা নন বা গনেশ কার্ত্তিক পুত্র নন) মহিষাসুরমর্দিনীর যে সকল মূর্তি পাওয়া যায় তার সিংহভাগই চৈতন্য সমসাময়িক কালে নির্মিত। টেরাকোটা শিল্পে সপরিবারের মহিষাসুরমর্দিনী অধিকাংশই ৫০০-৭০০ বছর আগে নির্মিত। ঋতুভিত্তিক দুর্গোৎসব জনপ্রিয় হয়েছে কিন্তু এরও পরে।
টেরাকোটায় দুর্গা 


দুর্গাপূজায় নবদ্বীপ ও চৈতন্যদেব 


অধিকাংশ ঐতিহাসিকই নবদ্বীপের বৈষ্ণব দিকটা নিয়ে আলোচনা করেন, কিন্তু নবদ্বীপের সংস্কৃতিতে যে একটি সুস্পষ্ট শাক্ত প্রভাব আছে তা অনেকেই খেয়াল করেন না। একদা নবদ্বীপ ছিল বঙ্গসংস্কৃতির প্রাণ কেন্দ্র, একা চৈতন্য মহাপ্রভুই নয় বহু শাক্ত পন্ডিতের চারণ ভূমি নবদ্বীপ ধাম। চৈতন্য মহাপ্রভু নিজেই শাক্ত প্রভাবমুক্ত ছিলেন না বলেই আমার মত। এই চৈতন্য মহাপ্রভুই ওড়িশা ভ্রমণ কালে শরৎকালে ভুবনেশ্বরে দুর্গাপুজোর আয়োজন করেন এবং একটি বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে চৈতন্য মহাপ্রভুর পুজোই ওড়িশার প্রথম দুর্গাপুজো। তার আগে উৎকলবাসীদের মধ্যে দুর্গাপুজোর কোনো চল ছিল না। চৈতন্য পূর্ববর্তী ও সমসাময়িক কালে নবদ্বীপের প্রধান উৎসব ছিল পট পূর্ণিমা যা কালক্রমে রাসকালি পূজো নামে খ্যাতি লাভ করে। আজও সেই ধারা অব্যাহত। এই উৎসব আজও স্বমহিমায় নবদ্বীপে অনুষ্ঠিত হয় প্রতি রাসপূর্ণিমায়। এটি সম্পূর্ন একটি শাক্ত উৎসব। ৫০০-৬০০ বছর ধরে নবদ্বীপের পন্ডিতরা কার্ত্তিক পূর্ণিমায় (যাকে বর্তমানে রাসপূর্ণিমা বলে) কুলদেবীর বাৎসরিক আরাধনায় করে আসছেন। নবদ্বীপের সেই কুলদেবীরা আর কেউ নয় মহিষাসুরমর্দিনী ও শ্যামাকালি যাঁরা কিনা বিভিন্ন নামে পূজিতা হন। সেই রকমই একটি দেবী হলেন ডুমুরেশ্বরী মাতা ও মহিষমর্দিনী মাতা, যাঁরা নবদ্বীপে নবদ্বীপে ৭০০ বছরের অধিক সময় ধরে পূজিতা।
নবদ্বীপ রাস পূর্নিমায়`ডুমুরেশ্বরী মাতা 



মহিষমর্দিনী মাতা, নবদ্বীপ রাস পূর্নিমা 


দুর্গার বাহন সম্পর্কে কিছু ভ্রান্তি ও সত্যতা অনুসন্ধান :


এবার আসি দেবীর বহন প্রসঙ্গে। কংসনারায়ণ যখন মাটি দিয়ে মূর্তি গড়ে দুর্গাপুজোর আয়োজন করেন তখন বাংলার মৃৎশিল্পীদের মধ্যে সিংহ বলে কোনো পশুর ধারণাই ছিল না। বাংলার মৃৎশিল্পীরা কস্মিনকালেও সিংহ দেখেননি। মহিষাসুরমর্দিনীর বাহন রূপে সিংহের আবির্ভাব একেবারে আধুনিক কালে মানে একশো থেকে দেড়শো বছরের মধ্যে। তাহলে দেবীর বহন কি ছিল?? বাংলার প্রাচীন মূর্তি গুলো খেয়াল করলে দেখবেন দেবীর বাহন ছিলো ড্রাগন জাতীয় পশুর মুখ ওয়ালা ঘোড়া সাদৃশ্য একটি পশু।যাকে গোধা বলা হয়। আসলে পশুটির মুখবায়বের গো-সাপের ও দেহ ঘোড়ার।  বাস্তমহিষাসুরমর্দিনী প্রাচীন শস্যের দেবী। যাঁর আরাধনা বঙ্গভূমিতে ৪০০০ বছর ধরে হয়ে আসছে, সেই অস্ট্রিকদের সময় থেকে। বাঙালি সংস্কৃতির একটি বড় অংশ দখল করে রয়েছে অস্ট্রিকরা। কৃষি প্রধান বাঙালি জীবন ওই অস্ট্রিকদের থেকেই পাওয়া। অস্ট্রিকরা প্রকৃতি শক্তির আরাধনা করতেন। গাছ, শস্য, নুড়ি, শীলা ইত্যাদির আরাধনা হত কিন্তু মনুষ্য বা পশু সাদৃশ্য মূর্তির পূজা করতেন না। নগর সভ্যতা ও স্থাপত্য, মূর্তি নির্মাণ এইসবই আদি দ্রাবিড়দের থেকে পাওয়া। অস্ট্রিকদের শস্যের দেবী কালক্রমে দ্রাবিড় প্রভাবে মহিষাসুরমর্দিনী হয়ে ওঠেন। ভেবে দেখুন এখনও দুর্গোৎসবে নবপত্রিকা (কলাবউ) আবশ্যিক। অস্ট্রিকরা এই নয়টি শষ্যকেই দেবীরূপে আরাধনা করতেন। আর দেবীর বাহন ছিল গো-সাপ। যাকে কিনা কৃষিকাজের উপকারী জীব হিসেবে ধরা হত। দ্রাবিড়রা নগর কেন্দ্রিক সভ্যতা গড়ে তোলার পর, যুদ্ধ বিগ্রহ ও রাজা, রাজত্বের ব্যাপার চলে আসে। রাজার রাজকীয়তা ও যুদ্ধবিগ্রহে সঙ্গী হলো ঘোড়া। যুদ্ধের দেবী ও শস্যের দেবী মিশে আজকের মহিষাসুরমর্দিনী। আর তাঁর বাহন গোঘোটক বা গোধাও উভয় সংস্কৃতির মিশ্রণ তৈরি। যা তৈরি হয়েছিলো খ্রিস্ট পূর্বে। আজও বনেদি বাড়ি গুলো সেই ধারা বহন করে আসছে।







পালযুগে ধাতুশিল্পে মহিষমর্দিনী  :


বর্তমানের ঢাকা শহরটি ঢাকার ঈশ্বরী (ঢাকেশ্বরীর) নামে নামাঙ্কিত। পুরোনো ঢাকার কেন্দ্রস্থলে যে ঢাকেশ্বরীর মন্দির রয়েছে সেটি বল্লাল সেনের প্রতিষ্ঠা। বল্লাল সেন ঢাকা ভ্রমণ কালে মাটিতে গাছের পাতায় ঢাকা অবস্থায় সপরিবারে মহিষাসুরমর্দিনী একটি মূর্তি খুঁজে পান। এই মূর্তিটি অষ্টধাতুর নির্মিত যার স্থাপত্য শৈলী প্রমান করে সেটিও পাল আমলে নির্মিত। পাল আমলে যে বাংলার সর্বত্রই মহিষাসুরমর্দিনীর আরাধনা হত ঢাকেশ্বরী মাতা তার অনন্য নজির। কারণ পাল আমলে নির্মিত মহিষাসুরমর্দিনীর মূর্তি গুলি বাংলার প্রায় সমস্ত অঞ্চল (গৌড়, রাঢ়, সমতট, বঙ্গ) থেকেই উদ্ধার হয়েছে। বর্তমানে এই মূর্তিটি কলকাতার কুমোরটুলিতে ঢাকেশ্বরীমাতার মন্দিরে রক্ষিত আছে।



অকাল বোধন , প্রচলিত ধারণা ও সত্যতা:

এবার আসি রামের আকালবোধন প্রসঙ্গে। পূর্বেই বলেছি, রাম যে কখনই আকালবোধন (দুর্গাপুজো) করেননি তার যথাযথ প্রমান রয়েছে। প্রথমেই যেটা বলা দরকার সেটা হলো বাল্মীকি রামায়ণে কোথাও আকালবোধন উল্লেখ নেই। অকালবোধন পুরোটাই কৃত্তিবাস বর্ণিত কাহিনী। সুতরাং রামই প্রথম দুর্গাপুজো করেছেন সেই দাবিও অসার। শ্রী শ্রী চণ্ডী থেকে জানা যাচ্ছে বাঙলার রাজা সুরথ ও সমাধি বৈশ্যই নদী তীরে মাটি দিয়ে প্রথম দুর্গাপুজো করেছেন। কৃত্তিবাসের দেওয়া দুর্গাপুজোর ফর্দতেও চরম অসঙ্গতি। বাংলার কবি কৃত্তিবাস রামের দেবীপুজোয় বাংলার হরেকরকম ফুলকে এনে হাজির করেছেন, আসলে যা হওয়ার কথা ছিল দক্ষিণ ভারতে। বাল্মীকি রামায়ণে দেখেছি, শরৎকালে দেবীপুজো করে রাবণবধের কোনো প্রশ্নই ওঠে না। কারণ রাবণ বধের সময় রামের বয়স ছিল আটত্রিশ বছর দশ মাস। চৈত্রের শুক্লা নবমী তিথিতে যাঁর জন্ম, সেই রাম কি ভাবে কি করে শরৎকালে আটত্রিশ বছর দশ মাস পূর্ণ করবেন??? এই থেকেই প্রমান হয় বাল্মীকি রাম কখনই দুর্গাপুজো করেননি, কারণ রাম রাবণ বধ করেছেন মাঘের হাড় কাঁপানো শীতে। তবে, শরৎকালে দুর্গাপুজোটা কৃত্তিবাসের মনগড়া নয়, রামের আকালবোধন ব্যাপারটাই শুধু মনগড়া ছিলো।কারণ  অবশ্য শরত কালে দুর্গাপূজ কংসনারায়ণ ও প্রথম করেন নি | রাজা কংসনারায়ণ যে দুর্গাপুজো করেছিলেন সেটা শরৎকালেই ছিলো। কৃত্তিবাস শরতের পুজোর ধারণাটা সেখান থেকেই পেতে পারেন। এমন কি মল্লরাজারাও ৯৯৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে বিষ্ণুপুরে মহিষমর্দিনীর মূর্তি ও মন্দির গড়ে শরৎকালে বাৎসরিক দেবীপুজো করে আসছেন।


দুর্গা মূর্তির বিবর্তন :



একটি বিষয় খুব গুরুত্ত্বপূর্ণ সেটা হলো মূর্তির বিবর্তন। পূর্বেই উল্লেখ করেছি মাটির মূর্তিতে সপরিবারে দুর্গার আরাধনা নয়শো থেকে হাজার খ্রিস্টাব্দে মধ্যে সূচনা হয়েছিলো। কিন্তু পাল যুগে যে সকল মহিষাসুরমর্দিনীর মুর্তি পাওয়া সবই সন্তানসন্ততী ছাড়া অর্থাৎ লক্ষ্মী সরস্বতী কার্তিক গণেশ অনুপস্থিত। মূর্তিগুলিতে দেবী রয়েছেন তাঁর দুই সখী জয়া-বিজয়ার সাথে। কালক্রমে ওই জয়া-বিজয়াই লক্ষী-সরস্বতীতে রূপান্তরিত হয়। কিন্তু, বাংলার একচালার মূর্তি শিল্পে গণেশ-কার্তিকের আবির্ভাব বিষয়ে এখনও আলোকপাত করা যায় নি। মেধস মুনিও মহিষমর্দিনীর সাথে আরও দুই দেবী লক্ষী-সরস্বতী মতান্তরে জয়া-বিজয়ার আরোধনা অর্থাৎ ত্রিদেবীর আরাধনাকেই দুর্গোৎসব বলে উল্লেখ করেছেন। নবদ্বীপ রাস উৎসব এখনও সেই প্রাচীন ধারাটাকেই বহন করে চলেছে। নবদ্বীপের রাস উৎসবের এখন যে সকল মহিষাসুরমর্দিনীর আরাধনা হয় সেসকল স্থানেই গণেশ ও কার্ত্তিক অনুপস্থিত। আমার মতে অপেক্ষাকৃত আধুনিক কালে, বাংলার লোকসংস্কৃতি ও লোকায়ত গল্প (যেমন- হরপার্বতী, উমাগিরিনন্দিনী) গুলি প্রাচীন মহিষমর্দিনী দেবীর উপর প্রভাব ফেলেছিল। কিংবা, উত্তরভারতীয় সংস্কৃতির প্রভাবে বাংলার মহিষাসুরমর্দিনী কালক্রমে উমা, পার্বতী, গিরিনন্দিনী ও গণেশজননীতে রূপান্তরিত হন এবং ওই সব লোকায়ত গল্পকে আশ্রয় করে আধুনিক যুগে গণেশ ও কার্ত্তিক ক্রমশ দেবীর সাথে একই কাঠামোয় জায়গা করে নিতে থাকে।



অনার্য ও অস্ট্রিক প্রভাব:


বাংলার মৃৎশিল্পে প্রতিমার চালচিত্র একটি গুরুত্ত্বপূর্ণ জায়গা নিয়েছে। শুরুতেই বলে রাখা ভালো যে প্রতিমা শিল্পে ডাকের সাজ( শোলার) ব্যবহার কিন্তু একেবারে আধুনিক যুগে( ব্রিটিশ আমলে)। বাঙালি প্রতিমার সাজপোশাক তৈরিতে শোলার ব্যবহার জানতো না। ইউরোপ থেকে ডাকের মাধ্যমে এই সাজ আসত, সেই থেকেই শোলার সাজের এমন নাম। কিন্তু প্রতিমার চালচিত্র বাঙালির সংস্কৃতির জীবনের এক অন্য ইতিহাসের নিদর্শন। অস্ট্রিক প্রভাবিত বাঙালি ধর্মীয় জীবনে আলপনা ও চিত্রের খুব প্রাধান্য ছিল। তাই পূর্বে বাঙালির বাৎসরিক পুজোপার্বন গুলিতে পটপুজোর প্রচলন ছিল। কিন্তু, রাজা কংসনারায়ণের আমল থেকে মাটির মূর্তিতে পুজোর প্রচলন শুরু হলে পটের গুরুত্ত্ব ক্রমশ কমতে থাকে। কালক্রমে পট বিবর্তিত হয়ে চালচিত্র রূপে দেবী প্রতিমার পেছনে স্থান করে নেয়। দেবী প্রতিমার পেছনের এই পটচিত্র ও আল্পনা  আরও একবার প্রমান করে দুর্গোৎসব একটি পূর্ন অনার্য উৎসব। অর্যাবর্তের সংস্কৃতির সাথে তার দূরত্ব অনেক।



দুর্গাপুজো সম্পর্কে ভ্রান্ত আর্য-অনার্য তত্ব ও আবহমান কালের প্রচলিত মিথ্যাচার সম্পর্কে কয়েকটি কথা  


বাংলায় মৃৎশিল্পে সর্বাধিক প্রভাব রয়েছে কংসনারায়ণ ঘরানায়। পূর্বেই বলেছি এই ধরনের ঘরানার মৃৎশিল্পের প্রতিমা এখন শুধুমাত্র কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতেই দেখা মেলে। কিন্তু কেমন ছিল এই ৯০০ খ্রিস্টাব্দেরর সেই কংসনারায়ণ ঘরানা?? আদি বাংলার মৃৎশিল্পে প্রতিমার মুখ হতো ত্রিকোণকার, দুই গালচাপা। কিছুটা চুয়াড় দেশের পুতুলের মত।পাতলা ঠোঁট, উন্নত চিবুক, ঘন কালো ছড়ানো দুই ভুরুতে বঙ্কিম টান,রুদ্রানীর ভুরু যুগল কান স্পর্শ করেছে। হটাৎ দেখলে মনে হয় দক্ষিণ-পশ্চিম বঙ্গের "টুসু"র প্রতিরূপ কিংবা "ছোউ"। এবার আসি চুয়াড় দেশের কথায়। আদি বাঙলার যে অংশটি ঝাড়খণ্ডের অন্তর্ভুক্ত ও বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের একেবারে পশ্চিম অংশই হলো লাল মাটির চুয়াড় দেশ। বাংলার এই অংশের মানুষের হলেন মুলনিবাসী বাঙালি, যাঁদের সংস্কৃতি সম্পুর্ন অনার্য অস্ট্রিক প্রভাবিত। বিশুদ্ধ বাংলার মূর্তির আদলটা এখন ওই দক্ষিণ পশ্চিম বাংলার আদিবাসী ( মুলনিবাসী বাঙালি)দের টুসু এবং ছোউ এরমধ্যেই খুঁজে পাওয়া যায়। টুসু আরণ্যক বাঙলার প্রাণের দেবী। ঝাড়খন্ডি মুলনিবাসী বাঙালি (আদিবাসী) তাঁদের সাথে অসুর-যোগের ভ্রান্ত ধারণা সম্পুর্ন খণ্ডন করে জানান "মহিষমর্দিনী" দুর্গা তাদেরই লৌকিক দেবী। কারণ তাদের শারদোৎসব শুরু হয় শরৎ শুরুর সাথে সাথেই। বরং, নয়শ শতকে রাঢ় বাঙলার একদল চুয়াড় শিল্পীই নাকি পূর্ব বাংলার কংসনারায়ণের গৃহঙ্গনে দুর্গাপ্রতিমা গড়েছিলো আরণ্যক বাঙলার "টুসু" ও "ছোউ" এর আদলে। তবে তাঁদের এই দাবি একেবারেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না, কারণ মৃৎশিল্পের ঐতিহ্য প্রাচীনকাল থেকেই অনার্য অস্ট্রিক মানুষের কাঁধে কাঁধেই বয়ে আসছে।




মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

চৈতন্য হত্যার অনুসন্ধানে - তমাল দাশগুপ্ত

প্রথম পর্ব  পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের পাণ্ডাদের মধ্যে একটা ভীষণ প্রবাদ চালু আছে, মালীবুড়োর শ্রীচৈতন্যের অন্তর্ধান রহস্য বইটা আমাদের জানাচ্ছে। এই পাণ্ডারা অনেকেই গর্ব করে বলে যে চৈতন্যকে তাদের পূর্বপুরুষেরা হত্যা করেছিল। কেন করেছিল? এরা বলে, এর কারণ চৈতন্য নাকি বাংলার মুসলমান শাসকের চর ছিলেন! আর তাই চৈতন্যর উড়িষ্যায় আগমনের পরেই প্রথমবারের জন্য গৌড়ের মুসলমান শাসক উড়িষ্যায় সফলভাবে হামলা করতে পেরেছিল। সাহসীজন এ ব্যাপারে পুরীতে গিয়ে উড়িয়া পাণ্ডাদের মধ্যে খোঁজখবর করে দেখতে পারেন এরকম একটা কথা চালু আছে কি না । চৈতন্য আন্দোলনের ফলে উড়িষ্যায় মুসলমান হামলা হয়েছিল, এই বক্তব্য এমনই জোরালো হয়ে ওঠে ক্রমে, যে প্রভাত মুখার্জি তার মেডায়েভাল বৈষ্ণবিজম ইন ওড়িশা গ্রন্থে এটিকে রীতিমত তথ্য ও যুক্তি দিয়ে খণ্ডন করেছেন, অর্থাৎ এটি উড়িয়ে দেওয়ার মত অকিঞ্চিতকর প্রলাপ নয়, অনেক উড়িষ্যাবাসী এতে বিশ্বাস করেন। ইন ফ্যাক্ট খোঁজ নিলে দেখবেন, অনুরূপ চাপা চৈতন্যবিদ্বেষ বাংলাভাষী হিন্দুত্ববাদীদের অনেকের আছে, এরাও একইরকম মনে করে। আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি যে চৈতন্যর সাম্যময় ভক্তি আন্দোলনের ফলে পাণ্ডাদের মৌ...

বাংলায় ব্রাহ্মণ

একদা এঁরা বাংলায় আসেন, রাজাদের পৃষ্ঠপোষণায় জমিজিরেত ও হরেক সুবিধা ভোগ করেন। অতঃপর আদিশূর নামে আধা-কল্পিত এক চরিত্রকে ঘিরে নিজেদের সামাজিক মর্যাদা আরও বাড়িয়ে নেন, সেই অনুযায়ী স্মৃতি, শাস্ত্র ও কুলজিগ্রন্থ রচনা করেন। ক্রমশ বৈদিক, রাঢ়ী, বারেন্দ্র, কুলীন, ভঙ্গ ইত্যাদি হরেক ভাগে বিভক্ত হয়ে যান। এঁরাই  বাঙালি ব্রাহ্মণ! কুণাল চক্রবর্তী ২৭ মে, ২০১৮, ০০:৩৪:৩৪ ব্রাহ্মণরা বাংলার আদি অধিবাসী নয়। বস্তুত দীর্ঘ দিন বাংলা ব্রাহ্মণদের প্রভাবসীমার বাইরে ছিল। বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকের নৃতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিকেরা লক্ষ করেছিলেন, ‘আর্য’রা পূর্ব ভারতে কিছুটা দেরিতে পৌঁছেছিল এবং তাদের অগ্রগতি স্থানীয় মানুষ প্রতিরোধ করেছিল। বাংলা অবশ্য শেষ পর্যন্ত ব্রাহ্মণ্য বলয়ের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল, কিন্তু প্রক্রিয়াটি খুব সহজ হয়নি। ব্রাহ্মণ্যবাদ যে ক্রমশ পূর্ব দিকে বিস্তৃত হচ্ছিল, প্রাচীন ব্রাহ্মণ্য সাহিত্যে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। অথর্ব বেদেই মগধ ও অঙ্গের প্রথম নিঃসংশয় উল্লেখ আছে। এই গ্রন্থটির মতে এ দুটি ছিল ব্রাত্যদের দেশ। বঙ্গের প্রথম দ্বিধান্বিত উল্লেখ পাই ঐতরেয় আরণ্যক গ্র...

শিকড়ের সন্ধানে-বেগুনিয়ার সিদ্ধেশ্বর মন্দিরেরডায়েরী; লিখেছেন শ্রী তিলক পুরকায়স্থ

শিকড়ের সন্ধানে-বেগুনিয়ার সিদ্ধেশ্বর মন্দিরের ডায়েরী। পশ্চিম বর্ধমান জেলার প্রান্ত বিন্দু বরাকর শহর, যার বহু প্রাচীন নাম বেগুনিয়া।এর পরেই শুরু দামোদর নদ এবং ঝাড়খন্ড রাজ্যের ধানবাদ জেলার।এখানে পৌঁছুতে হলে যে কোনো ট্রেন এ চেপে আসানসোল স্টেশন নেমে যান।ধর্মতলা থেকেও প্রচুর ভলভো বাস ছেড়ে আসানসোল আসে।আসানসোল থেকে বরাকর যাবার অগুনতি বাস ও মিনিবাস আছে।আবার black diamond/ coal field এক্স চাপলে, সোজা নামুন বরাকর।এখান থেকে পায়ে হেঁটে বা রিক্সা করে পাঁচ মিনিটে পৌঁছবেন গন্তব্যে। দামোদর নদের প্রায় কোল ঘেঁষে আছে এক সুপ্রাচীন-ঐতিহাসিক, নান্দনিক এবং অপরিসীম প্রত্নতাত্বিক মূল্যের মন্দিররাজি।বর্তমানে চারটি অপূর্ব সুন্দর পাথরের দেউল দাঁড়িয়ে আছে(আগে পাঁচটি ছিল), যার সমষ্টিগত নাম সিদ্ধেশ্বর মন্দির।এবং আপনাদের জ্ঞাতার্থে জানাই যে বাংলাদেশের প্রাচীনতম পাথরের দেউল হচ্ছে, এদের মধ্যে যেটি সামনের দিক থেকে শেষ বা চতুর্থ এবং ক্ষুদ্রতমটি। ওড়িশা রেখা বা শিখর রীতিতে তৈরি এই অপূর্ব সুন্দর দেউল গুলি কালের করাল গ্রাস জয় করে এখনো টিঁকে আছে।এ আমাদের পরম সৌভাগ্য।কিন্তু বাঙালি জাতির চরম ঔদাসীন্য, ঠুঁটো জগন্নাথ কতৃপক্ষ,...