সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

নীতিনকুমার বিশ্বাস

নীতিনকুমার বিশ্বাস পুলিশ-শিল্পী। কোচবিহারে মদনমোহন মূর্তি চুরি থেকে পুরুলিয়া অস্ত্রবর্ষণ মামলা, খাদিম-কর্তা অপহরণ থেকে সার্জেন্ট বাপি সেন হত্যা রহস্যের কিনারা হয়েছে তাঁর হাতের জাদুতে। বহু কুখ্যাত অপরাধী ধরা পড়েছে তাঁর আঁকা ছবির সূত্রে। 
দীপঙ্কর ভট্টাচার্য


কতই বা বয়স হবে তখন, বছর তেরো! বাড়ি ছেড়ে পালালেন নীতিন। পুলিশ তাঁকে উদ্ধার করল বজবজে, ট্রেনে। পাঁচ দশকেরও বেশি সময় আগে উত্তর ২৪ পরগনার বেড়াচাঁপা থেকে দক্ষিণ ২৪ পরগনার বজবজ যাওয়া সহজ ছিল না। পকেট ভর্তি পেনসিল, রং, তুলি-সহ ধরা পড়া ওই কিশোরকে পুলিশকর্তা যখন জিজ্ঞেস করলেন, কেন পালিয়েছিলে, নীতিনের জবাব— ‘‘আঁকব বলে। বাড়ির লোক আঁকতে দেয় না।’’


ঘরে ফিরলেন নীতিন, কিন্তু বুকের ভিতরের ঘরছুট ভাবটা রেহাই দেয়নি তাঁকে। আবারও ঘর ছেড়েছেন। সঙ্গী কাগজ-পেনসিল, রং-তুলি। বাবা চাইতেন পড়াশোনাতেই সময় দিক ছেলে। দাদা গোবিন্দলালেরও সেই ইচ্ছে। কিন্তু নীতিনকে বাঁধবে কে? রাতবিরেতে বিছানা খালি। নীতিন ঘুরছেন সার্কাসের তাঁবু বা পুজো প্যান্ডেলে। সেখানে ব্যাকগ্রাউন্ড বা অন্য আর্ট ওয়ার্কগুলো স্বেচ্ছায় এঁকে দিতেন। পয়সা নয়, তাঁর আনন্দ আঁকাতেই।


বেড়াচাপার এই ছেলেই এক দিন হয়ে উঠলেন ভারতবিখ্যাত। তাঁর পেনসিল ছুঁয়েই বিস্তার পেল ‘পোর্ট্রেট পার্লে’। নীতিনকুমার বিশ্বাস পুলিশ। কিন্তু লাঠি-বন্দুক নয়, তাঁর হাতে পেনসিল, তুলি। তিনি পুলিশ-শিল্পী। তাঁর পেনসিল স্কেচ চিনিয়ে দিয়েছে কুখ্যাত অপরাধীদের। খুন, ধর্ষণ, ডাকাতি, চুরি, অপহরণ— গত শতকের আশির দশক থেকে এই শতকের সূচনা পর্যন্ত ৭৩টি অপরাধের কিনারা করেছে তাঁর আঁকা ছবি। ১৯৮২-র দিল্লিতে নিরঙ্কারী বাবার হত্যাকাণ্ড থেকে সাম্প্রতিক অতীতে কলকাতা পুলিশের সার্জেন্ট বাপি সেন হত্যা রহস্য— অপরাধী ধরতে পুলিশের সহায় ছিলেন নীতিন। কলকাতা পুলিশ থেকে রাজ্য পুলিশ, সিআইডি কিংবা সিবিআই— তাঁর প্রতি প্রবল আস্থা ছিল সবার। ১৯৯৪ থেকে ২০০২-এর মধ্যে লিমকা বুক অব রেকর্ডস পাঁচ বার স্বীকৃতি দিয়েছে তাঁকে।


চিত্রশিল্পের এক বিশেষ আঙ্গিক এই পোর্ট্রেট পার্লে। ১৯৬০-এ মার্কিন শিল্পী হিউজ ম্যাকডোনাল্ড এর উদ্ভাবক। তাঁর সম্পর্কে বলা হয়, স্বপ্নে দেখা মানুষগুলোর ছবি আঁকতেন তিনি। এ দেশে সেই ধারার ছবি আঁকতে শুরু করেন নীতিন। ধরা যাক, কোথাও কোনও খুন, অপহরণ, ডাকাতির ঘটনা ঘটল। অপরাধী পালাল ঘটনার পর। তাকে খুঁজতে দরকার তার ছবি। প্রত্যক্ষদর্শী বা ঘটনার শিকার যাঁরা, তাঁরাই জানাতে পারেন তার চেহারা, বয়স, মুখের গঠন। সেই বর্ণনা শুনে না-দেখা এক জনের মুখাবয়ব ফুটিয়ে তুলতে হয় পোর্ট্রেট পার্লে শিল্পীকে।


নীতিনের কথায়: ‘‘প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা শুনতে হয় গভীর মনোযোগে। জানতে হয় মুখের কাঠামো, ভ্রুর প্রকৃতি, চোখ, নাক, ঠোঁটের গঠন। তার পর মনের মধ্যে ছবি আসতে থাকে। ওঁদের সামনেই স্কেচ শুরু করি। ছবি যত এগোয়, একটু একটু করে জেগে ওঠে প্রত্যক্ষদর্শীর মনের আয়না। তাঁরা নানান পরিবর্তন করতে বলেন। তাঁদের কথামতো অদলবদল করতে করতেই রূপ পায় ছবিটা। কান আর মনই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। পুলিশমহল আমাকে চিনত ‘কান দিয়ে দেখা মানুষ’ বলে!’’




ঘটনার শিকার বা প্রত্যক্ষদর্শীরা সাধারণত খুব অল্প সময়ের জন্য অপরাধীকে দেখেন। তাঁরা কি ঠিকঠাক মনে রাখতে পারেন? অপরাধীর বর্ণনা দিতে তাঁদের অসুবিধা হয় না? নীতিন বলেন, ওই মুহূর্তের দেখাটা অন্য সাধারণ দেখার মতো নয়। বর্ণনাকারীর স্মৃতিতে তা স্থায়ী জায়গা করে নেয়।


তাঁর কথায়, তালিম নিয়ে পোর্ট্রেট পার্লে শিল্পী হওয়া যায় না। একান্ত অনুভব না থাকলে ওই ছবি আসে না। তাঁর মা-ই নাকি তাঁর প্রশিক্ষক। তখন অনেক ছোট, সারা দিন মায়ের কাজ করার নানা ভঙ্গি দেখে রাখতেন। রাতে সে সব আঁকতেন। সেখানে তখন মা সশরীরে নেই। ‘‘কিন্তু মনের মধ্যে তাঁর ছবি পেতাম, জ্যান্ত মানুষ যেন।’’ এ ভাবেই আস্তে আস্তে হাত পাকে তাঁর। পুলিশে চাকরি পাওয়ার পর যখন আদেশ পেলেন পোর্ট্রেট পার্লে বানানোর, তখন আর অসুবিধে হয়নি। পুলিশের চাকরিতে এলেন কেন? নীতিনবাবুর জবাব, ‘‘একটা চাকরির খুব দরকার ছিল, আঁকাটা চালিয়ে যেতে। সুযোগটা যখন এল, আর বাছবিচার করিনি।’’


রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফাইন আর্টের উপরে পাঁচ বছরের ডিপ্লোমা কোর্স করেছিলেন নীতিন। তার পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে টিচার্স ট্রেনিং অব আর্ট অ্যাপ্রিসিয়েশন, ১৯৭৬-এ দিল্লির ইনস্টিটিউট অব ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড ফরেনসিক সায়েন্সে (আইসিএফএস) ফরেনসিক ফোটোগ্রাফির কোর্স। তত দিনে চাকরি পেয়েছেন কলকাতা পুলিশে, কনস্টেবল পদে। সেটা ১৯৭৪। তার আগে অবশ্য রাজ্য পুলিশে হোমগার্ডের অস্থায়ী চাকরি করেছেন। সিবিআই-এ ফোটোগ্রাফার-কাম-আর্টিস্ট পদে যোগ দিলেন ১৯৭৫-এ। নীতিন জানিয়েছেন, সিবিআই-এর তৎকালীন জয়েন্ট ডিরেক্টর ই এন রেনিসন তাঁর অ্যালবাম দেখে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে ডেকে নেন সিবিআইয়ে।


আশির দশকে নীতিন বিশ্বাসের কোনও বিকল্প ছিল না। তখন প্রযুক্তিগত সুযোগ সুলভ নয়, তৈরি হয়নি আজকের মতো ছবির সফ্টওয়্যার বা ফোটোশপ। দেশের অপরাধ-ভূগোলে নীতিনই ছিলেন পুলিশের সহায়। ১৯৯৫-এর পুরুলিয়া অস্ত্রবর্ষণ মামলা থেকে ২০০১-এর খাদিম-কর্তা অপহরণ বা ২০০২-এর আমেরিকান সেন্টারে জঙ্গি হানার মতো বড় ঘটনা তো আছেই। তাঁর ছবি কথা বলতে শুরু করেছিল ১৯৮২-তে, দিল্লিতে নিরঙ্কারী বাবা হত্যাকাণ্ডে। সেই সাফল্যে পালক জুড়ল ওই বছরই দিল্লিতে কুয়েতের রাষ্ট্রদূত হত্যার ঘটনায়। পরের বছর জর্ডনের রাষ্ট্রদূত হত্যার ঘটনায় দিল্লিতে যখন ডাক পড়ল তাঁর, তখন পুলিশ-প্রশাসনে পরিচিত নাম বছর চৌত্রিশের নীতিন। ১৯৮৭-তে গড়িয়াহাটে শিল্পপতি টাটাদের বাড়িতে ডাকাতি, পঞ্জাবের লুধিয়ানায় ছ’কোটি টাকার ডাকাতি, কোচবিহারে মদনমোহন মূর্তি চুরি, গার্ডেনরিচে পনেরো দিনের শিশু অপহরণ, লেক গার্ডেন্স-এ বিশ্বসুন্দরী সুস্মিতা সেনের দাদুর বাড়িতে চুরি, উত্তর ২৪ পরগনার ব্যারাকপুরে গৃহশিক্ষকের সঙ্গে প্রণয়সূত্রে বাবা-মা সহ পরিবারের সকলকে খুনের ঘটনা (সুদীপ্তা পাল কাণ্ড), শিয়ালদা-নৈহাটি ট্রেন লাইনে একের পর এক ছিনতাই ও ট্রেন থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেওয়ার ঘটনা (তিন জনের মৃত্যু হয়, এক জন বেঁচে যান, তিনিই বর্ণনা দিয়েছিলেন। ধরা পড়ে ছিনতাইকারী ও খুনি এক সাসপেন্ডেড রেল পুলিশকর্মী)। নীতিন বিশ্বাসের স্কেচ ধরিয়ে দেয় অপরাধীদের। পাশাপাশি তিনি লিখেছেন ‘পোর্ট্রেট পার্লে: হাউ টু ডু’, ‘ফরেনসিক ফোটোগ্রাফি’, ‘প্রিন্সিপল্‌স অব রিকনস্ট্রাকশন— স্কাল টু ফেসিয়াল কনট্যুর’-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ বইও।


নীতিন বলছিলেন স্বাতী পালের কথা। মুম্বইয়ের এই নর্তকীকে যখন গ্রেফতার করা হল খাদিম কর্তা অপহরণের ঘটনায়, তখন সে জেদি, একরোখা একটি মেয়ে। তার কাছ থেকেই নিতে হবে এই ঘটনার মূল চক্রীর ছবি। কিন্তু স্বাতী কিছুই বলতে চায় না। প্রথম দিন গেল। মুখোমুখি তিনি আর স্বাতী যে টেবিলে, তার থেকে কয়েক হাত দূরে দুঁদে পুলিশ অফিসাররা। স্বাতী গুম হয়ে বসে আছে। সকলে হতাশ। ‘‘আমার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। বললাম, স্বাতী, তুমি তো নাচগান করো, আমিও করি। মুম্বইয়ের শিল্পীরা বাংলায় এলে অধিকাংশ ফাংশনেই উদ্বোধনী সঙ্গীত গাই আমি,’’ বলতে বলতে নীতিন দেখলেন, স্বাতী চোখ তুলে দেখছে তাঁকে। তাঁর আস্থা অর্জন করতে হিন্দি গানও গাইতে হয় নীতিনকে। কয়েক দিনের পুলিশি জেরায় ক্লান্ত স্বাতী যেন একটু স্বাভাবিক হল। সুযোগ বুঝে নীতিন তাকে অনুরোধ করলেন গান গাওয়ার। গান ধরল স্বাতী। পরে আস্তে আস্তে খুলতে লাগল মনের কথার জট। ‘‘স্বাতী বিবরণ দিতে লাগল, আমি আঁকা শুরু করলাম। তার পর এমন ইনভলভ্‌ড হয়ে পড়ল ও, এক সময় আমার হাত থেকে পেনসিল নিয়ে নিজেই সংশোধন করতে লাগল ছবি!’’ ছবিটা তার পর এমন কাছাকাছি এল যে অপরাধী ধরতে দেরি হল না। সে সময়ের সংবাদমাধ্যম থেকে জানা যাচ্ছে, খাদিম-কর্তা অপহরণে জড়িত ছিল এমন এক লস্কর-ই-তৈবার সদস্য, যে মার্কিন তথ্যকেন্দ্রে হামলার সময়ও গুলি চালায়। নীতিনের স্কেচ যে দুই জঙ্গির মুখচ্ছবি নির্মাণ করে, তাদের এক জনের সঙ্গে মিল ছিল লস্কর-ই-তৈবার সেই সদস্যের মুখের। স্বাতী পাল ও আবদুর রহমানের সঙ্গে কথা বলে নীতিন যে ছবি এঁকেছিলেন তা পুলিশকে তদন্তে সাফল্য এনে দিয়েছিল।

কোচবিহারে মদনমোহন মূর্তি চুরির ঘটনাতেও নীতিনের স্কেচ যাকে ধরিয়ে দেয়, সেই অসীম ভট্টাচার্যকে অপরাধী বলে আগে কেউ ভাবতে পারেনি। দমদম পুরসভার চেয়ারম্যান, সিপিএম নেতা শৈলেন দাস হত্যাকাণ্ডে রাত দুটোয় ডাক পড়েছিল তাঁর। গোপনে এক প্রত্যক্ষদর্শীকে তুলে এনেছিল পুলিশ। ছবি আঁকিয়ে তিন দিনেই সাফল্য! ১৯৮৬-র ৩ ডিসেম্বর গার্ডেনরিচ থানা এলাকার ব্রেসব্রিজে ঝুপড়ি থেকে পনেরো দিনের যে শিশুকে অপহরণ করা হয়েছিল, তার মায়ের দেওয়া বর্ণনা শুনে আঁকা ছবি দেখে অপহরণকারী নাসিমা খাতুন ওরফে বিউটিকে গ্রেফতার করা হয় বিহারের গোপালগঞ্জ থেকে।


নীতিনকে চমকে দিয়েছিল আর এক কিশোরী, সুদীপ্তা পাল। গৃহশিক্ষকের সঙ্গে প্রণয়ের সূত্রে যে মেয়ে বাড়ির সবাইকে খুন করেছিল বিষ খাইয়ে। আড়াই দশক আগে উত্তর ২৪ পরগনার ব্যারাকপুর এলাকার সেই ঘটনায় ধরা পড়েন গৃহশিক্ষক, নীতিনবাবুর স্কেচের সূত্রেই। সুদীপ্তাও নাকি কিছু বলতে চায়নি প্রথম দিকে। নীতিনের কথায়, ‘‘জানলাম, ও কিছুই প্রায় খায়নি। অর্ডার দিলাম চা-টোস্টের। ও নির্বিকার। পকেট থেকে পেনসিল বার করে বললাম, এটা জাদু পেনসিল। এটা ছুঁইয়ে আমি যা ইচ্ছে আঁকতে পারি। তুমি শোনোনি আমার নাম? কাগজে পড়োনি আমার কথা? বলতে বলতেই চা খেতে ইশারা করলাম। ও কেমন বিমূঢ় হয়ে চায়ের কাপ হাতে তুলে নিল। তার পর বিবরণ দিল সেই শিক্ষকের। ছবি যখন শুরু হল, দেখলাম একেবারে ইনভলভ্‌ড হয়ে গেল সুদীপ্তা।’’


অনেক গল্প ঝুলিতে, তবু স্মৃতির রাজ্য অনেকটাই এলোমেলো এই সময়ের নীতিনের। প্রয়োজন কি ফুরিয়েছে তাঁর? বললেন, ‘‘এখন নতুন নতুন সফ্টওয়্যার, ফোটোশপে কাজ করা যাচ্ছে। তবে যন্ত্র সবটা পারে না। এ কাজে ছবির সঙ্গে একটা আত্মিক যোগ দরকার। সেটার অভাব এখন। হতাশই লাগে, আমার তো আর ঘুরে দাঁড়ানোর উপায় নেই! তবে কম্পিউটারে তৈরি ছবির সঙ্গে আমাদের করা ছবির অনেক তফাত। সিআইডি কেস নং ১০৮-এর ছবিটা দেখলেই বোঝা যাবে।’’


অসুস্থ শরীরে এখন আর পেনসিল ধরতে পারেন না। নার্ভের সমস্যায় আঁকার হাত আর বশ মানে না। বলেন, ‘‘বেঁচে আছি, অথচ আঁকতে পারব না, স্বপ্নেও ভাবিনি। মানতে কষ্ট হয়।’’ তাঁর লেটারবক্সে নামের পাশে বন্ধনীর মধ্যে এখনও লেখা ‘পুলিশ’। এই পুলিশ অপরাধ দমনে হাতে তুলে নিয়েছিলেন রং, তুলি, পেনসিল। আজ কাঁপা কাঁপা আঙুলের ফাঁক গলে ফসকে গিয়েছে সব।


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

চৈতন্য হত্যার অনুসন্ধানে - তমাল দাশগুপ্ত

প্রথম পর্ব  পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের পাণ্ডাদের মধ্যে একটা ভীষণ প্রবাদ চালু আছে, মালীবুড়োর শ্রীচৈতন্যের অন্তর্ধান রহস্য বইটা আমাদের জানাচ্ছে। এই পাণ্ডারা অনেকেই গর্ব করে বলে যে চৈতন্যকে তাদের পূর্বপুরুষেরা হত্যা করেছিল। কেন করেছিল? এরা বলে, এর কারণ চৈতন্য নাকি বাংলার মুসলমান শাসকের চর ছিলেন! আর তাই চৈতন্যর উড়িষ্যায় আগমনের পরেই প্রথমবারের জন্য গৌড়ের মুসলমান শাসক উড়িষ্যায় সফলভাবে হামলা করতে পেরেছিল। সাহসীজন এ ব্যাপারে পুরীতে গিয়ে উড়িয়া পাণ্ডাদের মধ্যে খোঁজখবর করে দেখতে পারেন এরকম একটা কথা চালু আছে কি না । চৈতন্য আন্দোলনের ফলে উড়িষ্যায় মুসলমান হামলা হয়েছিল, এই বক্তব্য এমনই জোরালো হয়ে ওঠে ক্রমে, যে প্রভাত মুখার্জি তার মেডায়েভাল বৈষ্ণবিজম ইন ওড়িশা গ্রন্থে এটিকে রীতিমত তথ্য ও যুক্তি দিয়ে খণ্ডন করেছেন, অর্থাৎ এটি উড়িয়ে দেওয়ার মত অকিঞ্চিতকর প্রলাপ নয়, অনেক উড়িষ্যাবাসী এতে বিশ্বাস করেন। ইন ফ্যাক্ট খোঁজ নিলে দেখবেন, অনুরূপ চাপা চৈতন্যবিদ্বেষ বাংলাভাষী হিন্দুত্ববাদীদের অনেকের আছে, এরাও একইরকম মনে করে। আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি যে চৈতন্যর সাম্যময় ভক্তি আন্দোলনের ফলে পাণ্ডাদের মৌ...

বাংলায় ব্রাহ্মণ

একদা এঁরা বাংলায় আসেন, রাজাদের পৃষ্ঠপোষণায় জমিজিরেত ও হরেক সুবিধা ভোগ করেন। অতঃপর আদিশূর নামে আধা-কল্পিত এক চরিত্রকে ঘিরে নিজেদের সামাজিক মর্যাদা আরও বাড়িয়ে নেন, সেই অনুযায়ী স্মৃতি, শাস্ত্র ও কুলজিগ্রন্থ রচনা করেন। ক্রমশ বৈদিক, রাঢ়ী, বারেন্দ্র, কুলীন, ভঙ্গ ইত্যাদি হরেক ভাগে বিভক্ত হয়ে যান। এঁরাই  বাঙালি ব্রাহ্মণ! কুণাল চক্রবর্তী ২৭ মে, ২০১৮, ০০:৩৪:৩৪ ব্রাহ্মণরা বাংলার আদি অধিবাসী নয়। বস্তুত দীর্ঘ দিন বাংলা ব্রাহ্মণদের প্রভাবসীমার বাইরে ছিল। বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকের নৃতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিকেরা লক্ষ করেছিলেন, ‘আর্য’রা পূর্ব ভারতে কিছুটা দেরিতে পৌঁছেছিল এবং তাদের অগ্রগতি স্থানীয় মানুষ প্রতিরোধ করেছিল। বাংলা অবশ্য শেষ পর্যন্ত ব্রাহ্মণ্য বলয়ের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল, কিন্তু প্রক্রিয়াটি খুব সহজ হয়নি। ব্রাহ্মণ্যবাদ যে ক্রমশ পূর্ব দিকে বিস্তৃত হচ্ছিল, প্রাচীন ব্রাহ্মণ্য সাহিত্যে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। অথর্ব বেদেই মগধ ও অঙ্গের প্রথম নিঃসংশয় উল্লেখ আছে। এই গ্রন্থটির মতে এ দুটি ছিল ব্রাত্যদের দেশ। বঙ্গের প্রথম দ্বিধান্বিত উল্লেখ পাই ঐতরেয় আরণ্যক গ্র...

শিকড়ের সন্ধানে-বেগুনিয়ার সিদ্ধেশ্বর মন্দিরেরডায়েরী; লিখেছেন শ্রী তিলক পুরকায়স্থ

শিকড়ের সন্ধানে-বেগুনিয়ার সিদ্ধেশ্বর মন্দিরের ডায়েরী। পশ্চিম বর্ধমান জেলার প্রান্ত বিন্দু বরাকর শহর, যার বহু প্রাচীন নাম বেগুনিয়া।এর পরেই শুরু দামোদর নদ এবং ঝাড়খন্ড রাজ্যের ধানবাদ জেলার।এখানে পৌঁছুতে হলে যে কোনো ট্রেন এ চেপে আসানসোল স্টেশন নেমে যান।ধর্মতলা থেকেও প্রচুর ভলভো বাস ছেড়ে আসানসোল আসে।আসানসোল থেকে বরাকর যাবার অগুনতি বাস ও মিনিবাস আছে।আবার black diamond/ coal field এক্স চাপলে, সোজা নামুন বরাকর।এখান থেকে পায়ে হেঁটে বা রিক্সা করে পাঁচ মিনিটে পৌঁছবেন গন্তব্যে। দামোদর নদের প্রায় কোল ঘেঁষে আছে এক সুপ্রাচীন-ঐতিহাসিক, নান্দনিক এবং অপরিসীম প্রত্নতাত্বিক মূল্যের মন্দিররাজি।বর্তমানে চারটি অপূর্ব সুন্দর পাথরের দেউল দাঁড়িয়ে আছে(আগে পাঁচটি ছিল), যার সমষ্টিগত নাম সিদ্ধেশ্বর মন্দির।এবং আপনাদের জ্ঞাতার্থে জানাই যে বাংলাদেশের প্রাচীনতম পাথরের দেউল হচ্ছে, এদের মধ্যে যেটি সামনের দিক থেকে শেষ বা চতুর্থ এবং ক্ষুদ্রতমটি। ওড়িশা রেখা বা শিখর রীতিতে তৈরি এই অপূর্ব সুন্দর দেউল গুলি কালের করাল গ্রাস জয় করে এখনো টিঁকে আছে।এ আমাদের পরম সৌভাগ্য।কিন্তু বাঙালি জাতির চরম ঔদাসীন্য, ঠুঁটো জগন্নাথ কতৃপক্ষ,...