সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

সখের বাজার চোরাবাগানের মিত্রবাড়ি ::Shokher Bazar Mitro Bari

সখের বাজার নেই, কিন্তু চোরবাগান নামটি থেকে গেছে। জলজঙ্গলের কলকাতায় সেই যে কবে গঙ্গা স্নানার্থীদের সর্বস্ব লুটপাট করে নিত চোর-ডাকাতের দল, তখন  থেকেই জায়গাটির নামের সেই কলঙ্ক ঘুচল না। অথচ অষ্টাদশ শতকে যে জমজমাট রঙিন বাজার বসত এখানে, যার থেকে নাম সখের বাজার, সেই নামটিই কিন্তু কবে লুপ্ত হয়ে গেছে। আজকের মুক্তারামবাবু স্ট্রিট অঞ্চলটিই চোরবাগান, সখের বাজারও ছিল এখানে । চোরবাগানের বিখ্যাত মিত্রবাড়িতে আসতে হলে এখানেই আসতে হবে ।
চিত্তরঞ্জন অ্যাভেনিউ দিয়ে মুক্তারামবাবু স্ট্রিট ঢুকে কয়েক পা এগোলেই ডান হাতে পড়বে মিত্রবাড়িএঁদের আদি বাড়ি কোন্নগরে। রামরাম মিত্র ছিলেন মুর্শিদাবাদের  নবাবের দেওয়ান। কোন নবাবের দেওয়ান তাঁর নামটি জানতে পারিনি। শুধু জানা যায়  দেওয়ানি থেকে প্রচুর অর্থ উপার্জনের পর রামরাম গোবিন্দপুরে এসে বসবাস ও ব্যবসাপত্র শুরু করেন। তাঁর ছেলে অযোধ্যারাম। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি গোবিন্দপুরে কেল্লার জন্য জমি নিলে অযোধ্যারাম চলে আসেন মেছুয়াবাজারে । তাঁর দুই ছেলে কৃপারাম ও জগন্নাথ । বিষয়সম্পত্তি ভাগ-বাঁটায়ারার পর কৃপারাম চলে গেলেন শুড়া গ্রামে (আজকের বেলেঘাটা অঞ্চলে), জগন্নাথ থাকলেন পৈতৃক বাড়িতেই। রাজা রাজেন্দ্রলাল মিত্ৰ কৃপারামের বংশধর ।
৩৫০ বছরেরও পুরনো  এই পরিবারের চোরাবাগানের বাড়িটি করেছিলেন জগন্নাথের ছেলে রামসুন্দর মিত্র, লোকমুখে যিনি খ্যাদারাম মিত্ৰ নামে পরিচিত ছিলেন। পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, ভূমিকম্পে এ-বাড়ির বাইরের অংশ ভেঙে যাওয়ায় ম্যাকিনটশ বার্নকে দিয়ে বাড়ির ভোল বদলে ফেলা হয় । প্রায় পাঁচ বিঘে জমির ওপর এই বাড়ি । উত্তরে মুক্তারামবাবু স্ট্রিট পূর্বে মিত্র লেন । মাকিনটশ বার্নের নকশায় বাড়িটির গৃয়ে যুক্ত হল বড় বড় থাম, পোর্টিকো। প্রধান প্রবেশপথ মুক্তারামবাবু স্ট্রিটে। বড় বড় ছটি খাম বাড়ির সামনের অংশকে দিয়েছে গ্রিক স্থাপত্যের চেহারা। মিত্র লেনের প্রবেশপথে চারটি থাম ও পোর্টিকো তারই সম্প্রসারিত রূপ। দরবারঘর, জলসাঘর, গোমস্তাখানা, ঠাকুরদালান ইত্যাদি নিয়ে বাড়িটি আগে ছিল দোতলা। পরে তিনতলা হয়েছে। সাবেক অন্দরমহলে খিলান-দেওয়া সিঁড়ি একতলা থেকে দোতলা পর্যন্ত উঠে গিয়েছে। ম্যাকিনটশ বার্ন সিঁড়িটিকে তিনতলায় পৌঁছে দিয়েছেন এবং তা করতে গিয়ে পুরনো খিলান রীতিটিকেই বজায় রেখেছেনকয়েকটি ঘরের মেঝোয় রঙবেরঙের কােচ বসানো । দেওয়ালে সাহেব-শিল্পীদের আঁকা বড় বড় তৈলচিত্র । কাঠের ফ্রেমে বসানো পিতল বা ব্রোঞ্জের তকমায় পাওয়া যায় শিল্পীদের নাম । কোন কোন ছবিতে আছে শিল্পীর স্বাক্ষর । ধূলিধূসরিত নামগুলি উদ্ধার করা কঠিন । পিতলের ছোট্ট তকমা ঝেড়েমুছে আমি শুধু স্পষ্ট একটি নাম খুঁজে পেয়েছিলামL.G. Bertonচিনের মিং আমলের নানা আকারের পোসিলিন ফুলদানি, ঝাড়লণ্ঠন, অ্যান্টিক আসবাবপত্র, মার্বেল পাথরের মূর্তি যে কোনও ঘরে ঢুকলেই কিছু-না-কিছু চোখে পড়বে। বিদেশে অ্যান্টিক ডিলারের কাছ থেকে কেনা একটি চিনা ফুলদানি দেখলামফুলদানির নীচে ইংরেজিতে টাইপ করা 1428 A.D. Ming dynasty. বর্তমান বংশধরেরা উত্তরাধিকারসূত্রে এই দুর্মুল্য শিল্পসামগ্ৰীগুলি পেয়েছেন। কলকাতার বনেদি বাড়িগুলিতে এই ধরনের শিল্পদ্রব্য কত যে ছড়িয়ে আছে! এগুলিকে সাজিয়ে-গুছিয়ে রাখলে কলকাতাতেই আমরা পেতে পারি আর-একটি সালার জং মিউজিয়ম । এইসব দুর্লভ শিল্পসামগ্ৰী কী করে সংগ্ৰহ করা হত, কে এগুলি বিক্রি করতেন, কী করেই বা এগুলি কলকাতায় আসত এ সম্পর্কে প্রশ্ন করেছিলাম অমিত মিত্রকে । মিত্র-পরিবারের এই তরুণ বংশধর প্রাচীন শিল্পকলা ও ইতিহাস সম্পর্কে যতটা আগ্রহী, ততটাই উৎসাহী পারিবারিক ইতিহাসের সযত্ন সংরক্ষণে। রাজা বিনয়কৃষ্ণ দেবের মৃত্যুর পর তাঁর সংগ্ৰহ মিত্ৰ-পরিবার যে নিলামে কিনেছিলেন তা তাঁর কাছেই জানা গেল । নবাব ও সাহেবসুবাদের সংগ্রহও নানা হাত বদল হয়ে কিছু কিছু কলকাতার প্রাচীন পরিবারগুলিতে এসেছে। এ ধরনের শিল্পদ্রব্য বিক্রির খোঁজখবর নিয়ে দালালরা ধনীদের বাড়ি-বাড়ি ঘুরতেন । দুর্লভ শিল্পদ্রব্য ধনী ব্যক্তিদের কিনিয়ে দিয়ে নিজেরাও লাভ করতেন। তা ছাড়াও ছিল কয়েকটি নিলাম কোম্পানি এবং সাহেবদের কিছু দোকান, যাঁরা ফ্রান্স, চিন, ইংল্যান্ড, ইতালির শিল্পসামগ্ৰী এ-দেশে আমদানি করতেন। এভাবে নানা সূত্র থেকে মিত্রবাড়ি শিল্পসামগ্ৰীগুলি সংগ্রহ করেছেন। তবে ঐশ্বর্যময় এত সংগ্রহের মধ্যেও একটি জিনিস চোখে পড়ল। এঁদের নিজস্ব লাইব্রেরি নেই। পূর্বপুরুষরা পুঁথি বা বই কিনতেন বলে মনে হল না |
 রামসুন্দর মিত্রের ছিল মহাজনী কারবার । এই কারবার থেকে তিনি প্রচুর টাকা করেছিলেন। লর্ড ক্লাইভকে তিনি দৈনিক সুদে টাকা ধার দিতেন। এককথায় তিনি ছিলেন ব্যাঙ্কার। মহাজনী কারবার রামসুন্দরের পরেও পরিবারের অনেকে করেছেন । সাহেবরাই শুধু তাঁদের কাছে টাকা ধার নেননি, নিয়েছেন কলকাতার বিখ্যাত পরিবারগুলির অনেকেই। কোনও পরিবার হয়তো সাহেবসুবোদের নিয়ে পার্টি ডেকেছেন বাড়িতে, কিন্তু মহানের খাজনা হয়তো তখনও এসে পৌঁছয়নি, অথচ ঠাটবাট বজায় রাখতেই হবে। তখনই  তাঁরা মিত্র-পরিবারের শরণাপন্ন হতেন।
রামসুন্দর চার পুত্র রেখে মারা যান। লেখাপড়ায় পুত্র মদনমোহনের মন ছিল না । পূজোয় তাই ওঁকে একবার মোটা কাপড় দেওয়া হয়। বাড়ি থেকে বেরিয়ে উনি নুনের ব্যবসায় প্রচুর টাকা করেন। বাড়িতে তখন আবার তাঁকে গ্ৰহণ করা হয়। মদনমোহনের তিন পুত্ৰদ্বারিকানাথ, দীননাথ ও অমৃতনাথ। কনিষ্ঠ অমৃতনাথের ছিল তীক্ষ্ণ বৈষয়িক বুদ্ধি। তিনি রায়বাহাদুর ও ইন্ডিয়ান মিউজিয়মের ট্রাস্টি হয়েছিলেন। একটানা ২০ বছর তিনি ছিলেন এই মিউজিয়মের কোষাধ্যক্ষ । ইন্ডিয়ান মিউজিয়মে আছে তাঁর আবক্ষ মূর্তি।
অমৃতনাথ তাঁর বড় দাদা নিঃসস্তান দ্বারিকানাথের নামে মেডিকেল কলেজে চক্ষু চিকিৎসা বিভাগের আউটডোর বাড়িটি করে দেন । এই আউটডোর বিভাগে ১৯০৩ সালের মার্বেল পাথরের ফলকটি তারই প্রমাণ বহন করছে। লেডি ডাফরিন হাসপাতালের জন্য উনি জমিও দিয়েছিলেন। স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় ও মহারাজা যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু অমৃতনাথ ছিলেন। কলকাতা পুরসভার কমিশনার ও প্রেসিডেন্সি ম্যাজিষ্ট্রেট। ১৮৬৭ সালে ওড়িশার মন্বন্তরে তিনি ২০ হাজার টাকা দিয়েছিলেন । তাঁর বড় ছেলে নরেন্দ্রনাথও দুর্ভিক্ষত্ৰণ তহবিল এবং ভিক্টেরিয়া মেমোরিয়াল ফান্ডে কয়েক হাজার টাকা দিয়ে গিয়েছেন তিনি ছিলেন ডাঃ কৈলাসচন্দ্র বসুর জামাতা, প্রেসিডেন্সি ম্যাজিষ্ট্রেট পুরসভার কমিশনার।
অমৃতনাথের ছোটো ছেলে গুণেন্দ্রনাথের বিয়েতে (২৬ এপ্রিল, ১৮৯৯) লেঃ গভর্নর জন উডবার্ন, বিচারপতি স্ট্যানলি, বিচারপতি স্টিভেনস ও কলকাতার বিশিষ্ট ব্যক্তিরা যোগ দিয়েছিলেন। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য মদনমোহনের মায়ের শ্ৰাদ্ধানুষ্ঠান। বিলেত থেকে -দেশে ফিরে যাঁরা একঘরে হয়ে গিয়েছিলেন ১৮৭৫ সালের ২২ ডিসেম্বর এই শ্ৰাদ্ধে তাঁদের বিশেষভাবে আমন্ত্রণ জানিয়ে আনা হয়েছিল। এই ঘটনার গুরুত্ব আজকে ঠিক ততটা বোঝা যাবে না কিন্তু তখনকার দিনে সেটা ছিল রীতিমত বৈপ্লবিক কাজ হাটখোলার দত্ত-পরিবার এবং রাজা কমলকৃষ্ণ রায় সেবার মিত্রদের সমর্থনে দাঁড়িয়েছিলেন
 নরেন্দ্রনাথের শ্ৰাদ্ধানুষ্ঠানের (বাংলা ১৩৩৮ সালের ১৪ চৈত্র) কথাও বলতে হয় অধ্যাপক-বিদায়ের তালিকায় তর্কবাগীশ, তর্কদৰ্শনতীর্থ, বাচস্পতি শাস্ত্রী, তর্কতীর্থ, বেদান্ততীৰ্থ স্মৃতিতীর্থ, বেদান্তবাগীশ, বেদান্ত শাস্ত্রী, ন্যায়তীর্থ, ন্যায়শাস্ত্রী, সিদ্ধান্তবাগীশ, গোস্বামী, পঞ্চতীর্থ, তর্কাচাৰ্য, তর্কসিদ্ধান্ত, বেদান্তরত্ন, সাংখ্য বেদান্ততীৰ্থ, ভাগবতরত্ন, সাংখ্যাতীৰ্থ, তর্করত্ন, স্মৃতিরত্ন, কাব্যতীর্থ, দৰ্শনতীর্থ, সাহিত্যশাস্ত্রী, সপ্ততীর্থ, তর্কনিধি, বিদ্যারত্ন, মীমাংসাতীর্থ,বিদ্যাবিনোদ, কাব্যস্মৃতিতীৰ্থ, বিদ্যাভূষণ, জ্যোতিঃশাস্ত্রী, কবিরত্ন, শিরোমণি, স্মৃতিভূষণ, বিদ্যানিধি, বিদ্যাবাগীশ, সাংখ্যবেদান্ত পুরাণতীর্থ-এরকম দেড় শতাধিক পণ্ডিতের নাম পাওয়া গেল। কাশী, নবদ্বীপ, ভাটপাড়া প্রভৃতি জায়গা থেকে তাঁরা একা আসেননি। এসেছিলেন ছাত্রসমেত। ছাত্রদেরও নগদ-বিদায় করা হয়েছিল। অধ্যাপক-বিদায়ের তালিকাটি দেখে একটি কথাই মনে পড়লসংস্কৃত পণ্ডিতদের আর টা খেতাব এর বাইরে থাকলে ? তালিকায় আমি একজন বিদ্যাসাগরের নামও পেয়েছি
 মিত্রবাড়ির পুরনো দফতর খুঁজলে এরকম কিছু কাগজপত্র পাওয়া যাবে অলকেন্দ্রনাথ মিত্রের আশীর্বাদ উপলক্ষে ভোজনের মেনু ছাপানো হয়েছিল। শুধু নিরামিষ ১১৭টি পদ আছে সেই তালিকায় তারিখ দেওয়া আছে১০ বৈশাখ, ১৩২৪ বনেদি বাড়ির উৎসব অনুষ্ঠানে কী ধরনের খাওয়াদাওয়া তালিকাটি পেশ করলে তার একটি ছবি পাওয়া যেতে পারে ; মোগলাই আলু ভাজা, মোগলাই শাকভাজা, মোগলাই বার্ত্তাকুভাজা, মোচার কাটলেট, কড়াই শুঁটির চপ, অপক্ক পনসের হসনী কারী, অপক পনসের কোপ্তকারী, মানকচুর ক্রুকেট, পটোলের দোরমা, অপক্ক পনসের কোর্ম্মা, ছানার মালাইকারী, ছানার মোহনমঞ্জরী, ফুলকপির চচ্চড়ী, কুষাণ্ডের ছোঁকা, আলুপটলের কালিয়া, ফেরাই, গ্রিল, ধোঁকা, ছোলার ডাইল, মুগের ডাইল, রসালের চাটনী, আলুবখারার চাটনী, রসমুখীর চাটনী, অদ্রাকের চাট্নি, মোচার শাসের কাবাব, বরবটির পলান্ন, বোঁদের পলান্ন, লুচি, মোহনপুরি, পাঁপড় ভাজা, রাধাবল্লভী, আলুন মুন, কচুরী, শিঙ্গেরা, নিমকি, পকৌড়ি,  দ্বিদল ভাজা, ঝুরি ভাজা, দরবেশ, বালুসাই, অমৃতসর জিলাপী, লেডিকেনী, কালকেন্দ, দুগ্ধসার লাড্ডুক, বাদামের বরফি, পোস্তার বরফি, গোলাপ জাম, গুজিয়া, ক্ষীরের মালপো, কুষ্মাণ্ডের কুরী, আবার খাবো, জলভরা তালশাঁস, বাদামতক্তি, বৈকুণ্ঠভোগ, গোলাপী পোড়া, মনোহরা, শর্করা মিশ্রিত দধি, রাবড়ি, ক্ষীরকমলা, ছানার পায়েস, কমলালেবুর জেলি, রসালের মোরব্বা, আমলকীর মোরব্বা, পটলের মোরব্বা, রসালের আচার, লঙ্কার আচার, করলার আচার, করঞ্জার আচার, অপক্ক পনসের আচার, চালদার আচার, তক্রের সরবত, রসালের সরবত, পনস, কৃষ্ণজম্বু, জামরুল,  ফলসা, নিচু, ক্ষীরিকা, পিয়ারা, শাকআলু, সিঙ্গাপুরী, কেশুর, আপেল, গোলাপজাম, কিসমিস, বাদাম, পেস্তা, খজুর, গোস্তনী (দ্রাক্ষা), জলগুজিয়া, আখরোট, খোপানী, বেদানা, পিজ, তরমুজ, আনারস, সরদা, লকেটফল, টেপারী, বৈচি, আতা, পাপিয়া, বিলাতী আম্রতক, তালশাঁস, নবনীত, ছানা (আমিীক্ষা), মিছরি, অপক্ক মুদগদ্বিদল, অপক্ক মধুময় রসাল, করকা সলিল, ছাঁচ তাম্বুল, মধুর তাম্বুল লেমনেড ১০২ নং পদটি উল্লেখ করা গেল না, কারণ তালিকার এই অংশটি ছেড়া | তালিকার অনেক পদই এখন আমাদের অনেকের কাছেই অপরিচিত ফেরাই কি ফ্রাই ? আর অপব্ধ পনসের হসনী কারী- বা কী বস্তু ? কারকাসলিল ? রান্নাবান্নার জগতেও আজ সেই রামও নেই, রামরাজত্বও নেই !
 শুধু হেঁসেলঘরেই মিত্রবাড়ির বৈশিষ্ট্য সীমাবদ্ধ ছিল না, পুজোআরচা বিদ্যাচর্চা, এমনকি খেলাধুলোর আসরেও আছে এঁদের নাম মিত্র-পরিবারের ৩৩০ বছরেরও বেশি কালীপুজো হয়ে আসছে চোরবাগানের মিত্রবাড়ির কালী শ্যামবর্ণ, তিনি ভয়ঙ্করী নন, ভয়হারিণী
আগে এই কালীর নাম ছিল মিঠাইকালী ১৮ ফুট প্রতিমার সমান মিষ্টান্ন স্তরে স্তরে সাজিয়ে দেওয়া হত নৈবেদ্য পুজোর পর তা বিলি করা হত দরিদ্রদের মধ্যে। লর্ড ক্লাইভ, ওয়ারেন হেস্টিংস এসেছেন। -বাড়ির কালীপুজোয়।
শুধু মহাজনী কারবার নয়, এঁদের জমিদারিও ছিল বেশ লাভজনক | গোবরডাঙার কাছে হাড়দাতপুরে জমিদারি কিনেছিলেন। ডালহৌসি স্কোয়ার, ইন্ডিয়া এক্সচেঞ্জ, ক্যানিং স্ট্রিট, বেন্টিঙ্ক স্ট্রিট, বড়বাজার, বউবাজার, লাউডন স্ট্রিট, পার্ক স্ট্রিট, কর্নওয়ালিশ স্ট্রিট, কুমারটুলি প্রভৃতি এলাকায় এরা ক্ৰমে-ক্রমে বিষয়সম্পত্তি বাড়িয়েছেন এইসব এলাকায় এদের ভাড়া বাড়ির সংখ্যা অনেক, নিজেদের বসতবাড়ির অংশবিশেষ ভাড়া দেবার প্রয়োজনই এঁরা অনুভব করেননি
এঁদের পরিবারে ব্যারিস্টার, অ্যাডভোকেট, ডাক্তার, এঞ্জিনিয়ার, ব্যাঙ্ক ম্যানেজার প্রভৃতি জীবিকার অনেকেই আছেন। প্রয়াত গৌরীনাথ মিত্র ছিলেন একদা এই রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেল ওষুধপত্র নানা কোম্পানির এজেন্সির ব্যবসাতেও কেউ-কেউ নিযুক্ত আছেন। পূবাঞ্চলীয় রনজি ট্রফির ম্যাচে বিজয়ী রাজ্যকে যে মোনা মিত্র মেমোরিয়াল চ্যালেঞ্জ কাপ দেওয়া হয়, সেই মেন মিত্র এই বাড়িরই ছেলে।
সুত্রঃ বনেদি বাড়ির ঘরবাড়ি-দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে গৃহিত



মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

চৈতন্য হত্যার অনুসন্ধানে - তমাল দাশগুপ্ত

প্রথম পর্ব  পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের পাণ্ডাদের মধ্যে একটা ভীষণ প্রবাদ চালু আছে, মালীবুড়োর শ্রীচৈতন্যের অন্তর্ধান রহস্য বইটা আমাদের জানাচ্ছে। এই পাণ্ডারা অনেকেই গর্ব করে বলে যে চৈতন্যকে তাদের পূর্বপুরুষেরা হত্যা করেছিল। কেন করেছিল? এরা বলে, এর কারণ চৈতন্য নাকি বাংলার মুসলমান শাসকের চর ছিলেন! আর তাই চৈতন্যর উড়িষ্যায় আগমনের পরেই প্রথমবারের জন্য গৌড়ের মুসলমান শাসক উড়িষ্যায় সফলভাবে হামলা করতে পেরেছিল। সাহসীজন এ ব্যাপারে পুরীতে গিয়ে উড়িয়া পাণ্ডাদের মধ্যে খোঁজখবর করে দেখতে পারেন এরকম একটা কথা চালু আছে কি না । চৈতন্য আন্দোলনের ফলে উড়িষ্যায় মুসলমান হামলা হয়েছিল, এই বক্তব্য এমনই জোরালো হয়ে ওঠে ক্রমে, যে প্রভাত মুখার্জি তার মেডায়েভাল বৈষ্ণবিজম ইন ওড়িশা গ্রন্থে এটিকে রীতিমত তথ্য ও যুক্তি দিয়ে খণ্ডন করেছেন, অর্থাৎ এটি উড়িয়ে দেওয়ার মত অকিঞ্চিতকর প্রলাপ নয়, অনেক উড়িষ্যাবাসী এতে বিশ্বাস করেন। ইন ফ্যাক্ট খোঁজ নিলে দেখবেন, অনুরূপ চাপা চৈতন্যবিদ্বেষ বাংলাভাষী হিন্দুত্ববাদীদের অনেকের আছে, এরাও একইরকম মনে করে। আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি যে চৈতন্যর সাম্যময় ভক্তি আন্দোলনের ফলে পাণ্ডাদের মৌ...

বাংলায় ব্রাহ্মণ

একদা এঁরা বাংলায় আসেন, রাজাদের পৃষ্ঠপোষণায় জমিজিরেত ও হরেক সুবিধা ভোগ করেন। অতঃপর আদিশূর নামে আধা-কল্পিত এক চরিত্রকে ঘিরে নিজেদের সামাজিক মর্যাদা আরও বাড়িয়ে নেন, সেই অনুযায়ী স্মৃতি, শাস্ত্র ও কুলজিগ্রন্থ রচনা করেন। ক্রমশ বৈদিক, রাঢ়ী, বারেন্দ্র, কুলীন, ভঙ্গ ইত্যাদি হরেক ভাগে বিভক্ত হয়ে যান। এঁরাই  বাঙালি ব্রাহ্মণ! কুণাল চক্রবর্তী ২৭ মে, ২০১৮, ০০:৩৪:৩৪ ব্রাহ্মণরা বাংলার আদি অধিবাসী নয়। বস্তুত দীর্ঘ দিন বাংলা ব্রাহ্মণদের প্রভাবসীমার বাইরে ছিল। বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকের নৃতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিকেরা লক্ষ করেছিলেন, ‘আর্য’রা পূর্ব ভারতে কিছুটা দেরিতে পৌঁছেছিল এবং তাদের অগ্রগতি স্থানীয় মানুষ প্রতিরোধ করেছিল। বাংলা অবশ্য শেষ পর্যন্ত ব্রাহ্মণ্য বলয়ের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল, কিন্তু প্রক্রিয়াটি খুব সহজ হয়নি। ব্রাহ্মণ্যবাদ যে ক্রমশ পূর্ব দিকে বিস্তৃত হচ্ছিল, প্রাচীন ব্রাহ্মণ্য সাহিত্যে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। অথর্ব বেদেই মগধ ও অঙ্গের প্রথম নিঃসংশয় উল্লেখ আছে। এই গ্রন্থটির মতে এ দুটি ছিল ব্রাত্যদের দেশ। বঙ্গের প্রথম দ্বিধান্বিত উল্লেখ পাই ঐতরেয় আরণ্যক গ্র...

শিকড়ের সন্ধানে-বেগুনিয়ার সিদ্ধেশ্বর মন্দিরেরডায়েরী; লিখেছেন শ্রী তিলক পুরকায়স্থ

শিকড়ের সন্ধানে-বেগুনিয়ার সিদ্ধেশ্বর মন্দিরের ডায়েরী। পশ্চিম বর্ধমান জেলার প্রান্ত বিন্দু বরাকর শহর, যার বহু প্রাচীন নাম বেগুনিয়া।এর পরেই শুরু দামোদর নদ এবং ঝাড়খন্ড রাজ্যের ধানবাদ জেলার।এখানে পৌঁছুতে হলে যে কোনো ট্রেন এ চেপে আসানসোল স্টেশন নেমে যান।ধর্মতলা থেকেও প্রচুর ভলভো বাস ছেড়ে আসানসোল আসে।আসানসোল থেকে বরাকর যাবার অগুনতি বাস ও মিনিবাস আছে।আবার black diamond/ coal field এক্স চাপলে, সোজা নামুন বরাকর।এখান থেকে পায়ে হেঁটে বা রিক্সা করে পাঁচ মিনিটে পৌঁছবেন গন্তব্যে। দামোদর নদের প্রায় কোল ঘেঁষে আছে এক সুপ্রাচীন-ঐতিহাসিক, নান্দনিক এবং অপরিসীম প্রত্নতাত্বিক মূল্যের মন্দিররাজি।বর্তমানে চারটি অপূর্ব সুন্দর পাথরের দেউল দাঁড়িয়ে আছে(আগে পাঁচটি ছিল), যার সমষ্টিগত নাম সিদ্ধেশ্বর মন্দির।এবং আপনাদের জ্ঞাতার্থে জানাই যে বাংলাদেশের প্রাচীনতম পাথরের দেউল হচ্ছে, এদের মধ্যে যেটি সামনের দিক থেকে শেষ বা চতুর্থ এবং ক্ষুদ্রতমটি। ওড়িশা রেখা বা শিখর রীতিতে তৈরি এই অপূর্ব সুন্দর দেউল গুলি কালের করাল গ্রাস জয় করে এখনো টিঁকে আছে।এ আমাদের পরম সৌভাগ্য।কিন্তু বাঙালি জাতির চরম ঔদাসীন্য, ঠুঁটো জগন্নাথ কতৃপক্ষ,...