মা
|
ত্র ১৩০০ টাকায়
বিক্রি হয়ে গেল কলকাতা। সেই সঙ্গে আরও দুটি গ্রাম—সুতানুটি ও গোবিন্দপুর । ১৬৯৮ সালের ১০ নভেম্বর। বড়িশার সাবর্ণ রায়চৌধুরী
পরিবারের কাছ থেকে সেদিনের সেই তিনটি অজ পাড়া গাঁ কিনে নিয়েছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়৷ কোম্পানি
। ওই তিনটি গ্রাম নিয়ে আস্তে-আস্তে গড়ে উঠল আজকের জমজমাট শহর কলকাতা । আর ওদিকে
তখন সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের ঘরবাড়ি ভাঙতে-ভাঙতে শরিকদের মধ্যে ভাগবাঁটোয়ারা হতে
হতে প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। অতীতের নিদর্শন বলতে আছে এখন প্রায় ৩৭০ বছরের
পুরনো দুৰ্গাপুজোটি, ঠাকুরদালান, তার সামনে আকাশ মাথায় নিয়ে
দাঁড়িয়ে-থাকা আটচালার কয়েকটি থাম এবং কুলদেবতা রাধাকান্ত জিউয়ের বিগ্রহ। পুরনো
বাড়ির শেষ চিহ্ন বলতে আছে, ৬৪ সাবর্ণপাড়া রোডের
প্রায়ান্ধকার, সঙ্কীর্ণ একটি ঘুলঘুলি এবং কাদামাটি দিয়ে
গাঁথা পাতলা ইটের ৪৫ ইঞ্চি দেওয়াল। আজ যখন বাড়ি তৈরি করতে ৫ ইঞ্চি বা ১০ ইঞ্চি
দেওয়ালই যথেষ্ট, সেখানে এরকম ৪৫ ইঞ্চি পুরু দেওয়াল উল্লেখ
করার মতো বিষয়।
লক্ষ্মীকান্ত মজুমদার হিজরি ১০১৫ বা ইংরেজি ১৬২৬ সালে মহারাজা মানসিংহের সুপরিশে মুঘল দরবার থেকে মজুমদার ও রায়চৌধুরী উপাধি পেয়েছিলেন। সেবার মানসিংহের সুপরিশে ওই একই উপাধি পেয়েছিলেন নদীয়া রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ভবানন্দ ও পাটুলির রাজা জয়ানন্দ। লক্ষ্মীকান্ত মজুমদারের জন্ম ইংরেজি ১৫৭০ সালে। মৃত্যু ১৬৪৯ সালে। সংস্কৃত, বাংলা ও ফার্সি ভাষায় তাঁর ভাল দখল ছিল । তিনি নবাব সরকারের কর্মী ছিলেন। মুঘল দরবার থেকে উপাধি পাওয়ার কিছু পরে ইনি হাবিলিশহর বা আজকে হালিশহরে বিরাট অট্টালিকা তৈরি করেছিলেন। সেই জায়গাটি এখন চৌধুরীপাড়া নামে পরিচিত। লক্ষ্মীকান্ত হাবিলিশহর, মাগুরা, খাসপুর, পইকান, আনোয়ারপুর, কলিকাতা পরগনা এবং হেতেগড় পরগনার কিছু অংশ জায়গির পেয়েছিলেন। এই পরগনাগুলি আগে সম্ভবত মহারাজা প্রতাপাদিত্যের পিতৃব্য রাজা বসন্ত রায়ের জমিদারির অন্তর্ভুক্ত ছিল।
আজকের কলকাতার বিনয়-বাদল-দীনেশ বাগ
এলাকার লালদিঘির পাশের কোনও জায়গায় লক্ষ্মীকান্তের ইটের তৈরি কাছারিবাড়ি ছিল।
ছিল শ্যামরায়ের মন্দির। শ্যামরায়ের মন্দির-প্রাঙ্গণে মহাসমারোহে আবির ও কুমকুম
সহযোগে খেলা হত দোল । তারপর সবাই স্নান করত দিঘিতে। দিঘির জল আবির-কুমকুমে লাল
হয়ে যেত। সেই থেকে দিঘির নাম হয়েছে লালদিঘি। জোব চার্নক নাকি লক্ষ্মীকান্তের
কাছারিবাড়ি বন্দোবস্ত নিয়ে সেখানে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রথম অফিস করেছিলেন
। ১৭০১ সালে ফোর্ট উইলিয়ম দুর্গ হওয়ার পর কাছারিবাড়িটি ভেঙে দেওয়া হয়।
জোব চার্নক নাকি বড়িশায় সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের
ঠাকুরদালান সংলগ্ন আটচালায় বসে সুতানুটি, গোবিন্দপুর ও কলকাতা কেনার কথাবাত পাকা করেছিলেন ।
সেই আটচালায় চার্নককে সাদর অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন বিদ্যাধর রায়চৌধুরী । এই
সুতানুটি, গোবিন্দপুর ও কলকাতা কেনার জন্য ইস্ট ইন্ডিয়া
কোম্পানি বাংলার সুবেদারকে ১৬০০০ টাকা ঘুষও দিয়েছিলেন। ঔরঙ্গজেবের পৌত্র সুলতান
আজিম ওসমান তখন বাংলার শাসনকতা। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নাকি গ্রাম তিনটি
কিনেছিলেন রাম রায়, মনোহর দাস ও রায়চৌধুরী পরিবারের
অন্যান্য শরিকের কাছ থেকে । এ-সংক্রান্ত মূল দলিলটি আছে লন্ডনের ব্রিটিশ মিউজিয়মে
। রায়চৌধুরীরা যে জোব চার্নককে কলকাতা বিক্রি করেছিলেন এমন কোনও প্রমাণ নেই।
গ্রাম তিনটি কেনার ব্যাপারে চার্নক হয়তো প্রাথমিক কথাবার্তা বলেছিলেন । কোম্পানির
হয়ে গ্রামগুলি কিনেছিলেন ওয়ালশ নামে এক ইংরেজ । মূল দলিলটি হয়েছিল ফার্সিতে ।
তাতে যৌথ বিক্রেতা হিসেবে নাম আছে মনোহর দেউ, বিদ্যাধরের
ছেলে রাম চাঁদ, রাম দেউ-এর ছেলে রামবাহাদুর, প্রাণ এবং গন্ধর্বের। তাঁরা বিক্রি করছেন আমিরাবাদ পরগনার অধীন ডিহি
কলকাতা, সুতানুটি এবং গোবিন্দপুর ।
এরকম মতও প্রচলিত আছে যে, রায়চৌধুরীরা গ্রাম
তিনটি প্রথমে বিক্রি করতে চাননি । তাঁরা নানা আপত্তিও জানিয়েছিলেন । তবে সে
আপত্তি ধোপে টেকেনি। এর কারণ ১৬০০০ হাজার টাকা ঘুষ দিয়ে আজিম ওসমানের ছেলে
ফারুকসিয়ারের কাছ থেকে ইংরেজরা আগেই অনুমতি এনেছিলেন। রায়চৌধুরীদের তখন আর কিছু
করার ছিল না । রায়চৌধুরী পরিবারের কত বিদ্যাধর কোম্পানির নথিপত্র রাখার জায়গা
নেই দেখে লালদিঘির দক্ষিণ প্রান্তে তাঁর কাছারিবাড়িটি তাঁদের ব্যবহার করতে
দিয়েছিলেন। ব্রিটিশ রাজশক্তির শক্তিসামর্থ সম্পর্কে রায়চৌধুরীরা বিলক্ষণ খোঁজখবর
রাখতেন । কিন্তু তাঁরা স্বপ্নেও ভাবেননি, যে তিনটি গ্রামের
অধিকার তাঁরা ছেড়ে দিচ্ছেন সেই তিনটি গ্রামই একদিন ব্রিটিশ কমনওয়েলথের দ্বিতীয়
বৃহত্তম শহর হবে। এবং সেই শহরটিকে কেন্দ্র করে ব্রিটিশরা ক্ৰমে-ক্রমে এই
উপমহাদেশের বিশাল ভূখণ্ড গ্রাস করে নেবে।
আজকের বড়িশায় গেলে সেদিনের সেই ইতিহাসের ছিটেফোঁটাও
খুঁজে পাওয়া যাবে না। বড়িশা নামের উৎপত্তির পেছনেও যে একটি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস আছে
তাই বা কজন জানতে পারবেন? রাজস্ব আদায়ের সুবিধার জন্য নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ
১৭২২ সালে বাংলাকে ১৩টি চাকলা ও বহু পরগনায় ভাগ করেছিলেন। কেশবরাম রায়চৌধুরী
বাংলার দক্ষিণ চাকলার রাজস্ব আদায় করতেন। সবচেয়ে বেশি রাজস্ব তিনি আদায়
করতেন বলে হিংসাও পেতেন বড় রকমের। বড় হিংসা থেকেই নাকি কেশবরামের বাসস্থানের
জায়গার নাম হয়েছে বড়িশা। কেশবরামের জন্ম ইংরেজি ১৬৫০ সালে। মৃত্যু ১৭২৬ সালে ।
তাঁর আমলে বাহান্ন পীঠের অন্যতম কালীদেবীর পীঠস্থান কালীক্ষেত্র বা ‘কালীকোঠা"
নামে অভিহিত হত। অগণিত তীর্থযাত্রীর পুণ্যস্নানের সুবিধার জন্য তিনি
কালীক্ষেত্রের মন্দির চত্বরের কাছে আদি গঙ্গার ঘাট তৈরি করে দেন। সেই থেকে
কালীক্ষেত্র হয়ে ওঠে কালীঘাট । কালীর একটি ছোট মন্দিরও তিনি তৈরি করে দিয়েছিলেন
। কালীঘাট ছিল রায়চৌধুরীদের জমিদারির অংশ। কিন্তু এই পরিবারে কালীপুজোর চল নেই
বলে শোনা গেল। অথচ একসময় এঁদের বাড়ি থেকে নৈবেদ্য না গেলে কালীঘাটে পুজো হত না।
প্রতিমা গড়ে সরস্বতী, জগদ্ধাত্রী এসব পুজো হয়।
কিন্তু রায়চৌধুরী পরিবারের সবচেয়ে
বিখ্যাত বলতে দুর্গাপুজো । ৩৭০ বছর ধরে এই পুজো চলে আসছে। লক্ষ্মীকান্তের আমলে এর
সূচনা হয়। তাঁর আমলে প্রথম যে কাঠামোয় প্রতিমা গড়া হয়েছিল সেই কাঠামোটিতেই আজও
প্রতিমা গড়া হয়। দুর্গা মন্দিরের পশ্চিমে রাধাকান্ত মন্দির । আটচালায় আসার পথের
দুপাশে পড়ে দ্বাদশ শিব মন্দির। গার্লস হাই স্কুলের কাছে রাধাকান্তের দোলমঞ্চ ।
রাধাকান্তকে সেখানে নিয়ে প্রতিবার দোল খেলা হয়। সেখানে বসে রাসের মেলা ।
সাবর্ণ কথাটা কারও নাম নয় । এটা
পদবি। এক সময় জমিদারির আয়ে হেসেখেলে যাদের সংসার চলে যেত এখন তাঁর কেউ কেউ
ব্যবসা করছেন, কেউ কেউ নিয়েছেন চাকরি । কেউ খুলেছেন চুন-সুরকির দোকান, কেউ হয়েছেন মেকানিকাল এঞ্জিনিয়ার। একদিন মাত্র ১৩০০ টাকায় বিকিয়ে
গিয়েছিল তাঁদের কলকাতা—এ নিয়ে কিন্তু আজকের বংশধরদের
মনে কোনও কষ্ট নেই। বরং যে যেমনভাবে পারেন নিজেদের পূর্বপুরুষদের স্মৃতিরক্ষা
করে চলেছেন ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন