সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

শিকড়ের সন্ধানে-বেগুনিয়ার সিদ্ধেশ্বর মন্দিরেরডায়েরী; লিখেছেন শ্রী তিলক পুরকায়স্থ


শিকড়ের সন্ধানে-বেগুনিয়ার সিদ্ধেশ্বর মন্দিরের
ডায়েরী।
পশ্চিম বর্ধমান জেলার প্রান্ত বিন্দু বরাকর শহর, যার বহু প্রাচীন নাম বেগুনিয়া।এর পরেই শুরু দামোদর নদ এবং ঝাড়খন্ড রাজ্যের ধানবাদ জেলার।এখানে পৌঁছুতে হলে যে কোনো ট্রেন এ চেপে আসানসোল স্টেশন নেমে যান।ধর্মতলা থেকেও প্রচুর ভলভো বাস ছেড়ে আসানসোল আসে।আসানসোল থেকে বরাকর যাবার অগুনতি বাস ও মিনিবাস আছে।আবার black diamond/ coal field এক্স চাপলে, সোজা নামুন বরাকর।এখান থেকে পায়ে হেঁটে বা রিক্সা করে পাঁচ মিনিটে পৌঁছবেন গন্তব্যে।
দামোদর নদের প্রায় কোল ঘেঁষে আছে এক সুপ্রাচীন-ঐতিহাসিক, নান্দনিক এবং অপরিসীম প্রত্নতাত্বিক মূল্যের মন্দিররাজি।বর্তমানে চারটি অপূর্ব সুন্দর পাথরের দেউল দাঁড়িয়ে আছে(আগে পাঁচটি ছিল), যার সমষ্টিগত নাম সিদ্ধেশ্বর মন্দির।এবং আপনাদের জ্ঞাতার্থে জানাই যে বাংলাদেশের প্রাচীনতম পাথরের দেউল হচ্ছে, এদের মধ্যে যেটি সামনের দিক থেকে শেষ বা চতুর্থ এবং ক্ষুদ্রতমটি। ওড়িশা রেখা বা শিখর রীতিতে তৈরি এই অপূর্ব সুন্দর দেউল গুলি কালের করাল গ্রাস জয় করে এখনো টিঁকে আছে।এ আমাদের পরম সৌভাগ্য।কিন্তু বাঙালি জাতির চরম ঔদাসীন্য, ঠুঁটো জগন্নাথ কতৃপক্ষ, স্থানীয় অতি উৎসাহী ভক্তদের তান্ডবে কতদিন আর টিঁকবে জানিনা।ASI সংরক্ষিত স্থান হলেও, সারাদিন ধরে ভক্তদের ফুল, বেলপাতা, সিঁদুর লেপা এবং ঘড়া ঘড়া জল শিবলিঙ্গের ওপর ঢালা, এত ধর্মের আতিশয্যে, একটি মন্দির বহু আগেই ধ্বংস হয়ে গেছে।Beglar সাহেব পঞ্চম মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ এর বিবরণ দিয়েছেন, এখন সেই পঞ্চম মন্দিরের চিহ্ন মাত্র নেই।এ ছাড়াও অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেছে সামনের বাঁ দিকের মন্দির গাত্রের শিলালিপি টার।
বিনয় ঘোষের লেখা থেকে জানা যায় যে শিলালিপিটিতে লেখা আছে- ১৩৮২ শকাব্দে (বা ৭৮ যোগ করলে ১৪৬০ খ্রিস্টাব্দে) ফাল্গুন মাসের শুক্ল পক্ষে অষ্টমী তিথিতে জনৈক রাজা(?) হরিশ্চন্দ্রের স্ত্রী হরিপ্রিয়া তাঁদের ইস্টদেবতা শিবের উদ্দেশ্যে এই মন্দির নির্মাণ করেন। তৃতীয় মন্দিরের শিলালিপি অনুসারে ১৪৬৮ শকাব্দে (১৫৪৬ খ্রিস্টাব্দে) জনৈক ব্রাহ্মণ নন্দ এবং তাঁর স্ত্রী এই মন্দিরটি সংস্কার করেছেন।অর্থাৎ মন্দিরটি আরো আগে নির্মিত।সঙ্গে আনা কম্পাস দেখাচ্ছে তৃতীয় মন্দিরটি পশ্চিমুখী, বাকিগুলো সব পূবমুখী।
বেগুনিয়া নামটি শুনে হয়তো একটু কৌতূহল হচ্ছে- এই নামের অর্থ কি? ওড়িশা শৈলীর এই মন্দিরগুলির শিখরের আকৃতির সঙ্গে অনেকাংশে আধকাটা বেগুনের সাদৃশ্য আছে বলে এই জায়গার নাম বেগুনিয়ার মন্দির।খোদ ওড়িশাতেও এরকম একটি দেউল গ্রামের নাম বেগুনিয়া।
প্রতিটি মন্দির গাত্রে অসম্ভব সুন্দর সুন্দর সব পাথরের মূর্তি- যথা উড়ন্ত সিংহ, মকর, রাক্ষসের মতন কীর্তিমুখ(যা শিব মন্দিরের বিশেষত্ব।স্কন্ধ পূরণে বলা হয়েছে, শিবের আদেশে জলন্ধর রাক্ষস নিজের শরীরকে নিজে গিলে ফেললে, শিব তার নাম নাম দেন- কীর্তিমুখ বা face of glory. )
এ ছাড়াও বিভিন্ন দেবদেবী, অনন্তসজ্জায় বিষ্ণু, অসংখ্য মৎসকন্যা আছে মন্দির জুড়ে।
চতুর্থ মন্দিরের আরাধ্য দেবতা সিদ্ধেশ্বর শিবের নামেই এই মন্দিররাজির নাম সিদ্ধেশ্বর মন্দির।এই ছোট মন্দিরটি বাংলার সর্বপ্রথম দেউল এবং সম্ভবত অষ্টম শতকে নির্মিত।প্রথম মন্দিরে তিনটি শিবলিঙ্গ ও কালী মূর্তি, দ্বিতীয় টিতে তিনটি শিবলিঙ্গ ও গনেশ মূর্তি, তৃতীয় মন্দিরটিতে পাঁচটি শিবলিঙ্গ ও একটি পাথরের মাছ দেখা যায়।মাছ বা মীন সম্ভবত নারী শক্তির প্রতীক। J.D.Beglar সাহেব লিখেছেন- The sculpture represents a fish 5 ft.9 inches long from snout to the tip of the tail, 2ft.3 inches wide at the swell below the head and 1ft. 9inches at the junction of the tail. The tail itself is 9 inches long by 2 feet 1 inch wide at its extremity.
পাথরের তৈরি দেউল মন্দির পশ্চিমবঙ্গে বিরল।অলংকরণ, আকার, নান্দনিকতা দিয়ে বিচার করলে একমাত্র পুরুলিয়ার বান্দার দেউল এর সঙ্গেই বেগুনিয়ার মন্দিরের তুলনা করা যায়।
চতুর্থ মন্দিরটি নিয়ে কিছু বলা অপ্রাসঙ্গিক হবে না।আগেই বলেছি রেখা বা শিখর দেউল এর সর্ব প্রাচীন উদাহরণ এটি। নিচু ভিতের ওপর উঁচু গর্ভগৃহ।গোড়া থেকেই শিখরের ক্রমবক্র রেখা উর্দ্ধে উঠে গেছে।শিখরের পগ রেখাগুলি যেন অসংখ্য লোহার পাতের মতন মন্দিরকে বেষ্টন করে আছে।শিখরের উপর একটি বৃহৎ আমলক শিলা(গোল চাকতির মতন খাঁজ কাটা)।স্থাপত্যের দিক দিয়ে এই মন্দিরটি ভুবনেশ্বর এর পরশুরামেস্বর মন্দিরের সমকালীন, অর্থাৎ অষ্টম শতকে তৈরি।(মন্দির স্থাপত্য-১৪,শিল্পকলা- বাংলা লাইব্রেরি) পরশুরামেস্বর মন্দিরে বিমানের সঙ্গে যুক্ত আছে জগমোহন, যা এই মন্দিরে নেই।এছাড়া ওড়িশার রেখা দেউল এর মন্দির গুলির আমলক হয় 'convex', কিন্তু বরাকর মন্দিরের আমলক গুলি concave.(বিনয় ঘোষ, পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি)।
তাহলেই বুঝুন, কি চমৎকার এবং ঐতিহাসিক মূল্যের স্থাপত্য আমাদের বাংলায় আছে যার সম্মন্ধে আমরা উদাসীন, কোনো খোঁজও রাখিনা।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন কালে আপন ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর যে বিযুক্তি ও ব্যাবধান রচিত হয়েছিল, দুঃখের বিষয় সেই বিযুক্তি এখন আরো বেড়েছে।জাতি সত্তার ইতিহাসের গর্ব ছাড়া কোনো জাতির উন্নতি হতে পারে না।তাই অনুরোধ করছি এই অমূল্য সম্পদগুলিকে দেখুন, চিনুন, অনুভব করুন। আমরা যে আত্ম বিস্মৃত জাতি নই তা প্রমাণ করুন।
ফেসবুক থেকে সংগৃহীত
Tilak Purkayastha > Indian art and architecture

https://m.facebook.com/groups/sthapatya.kala/ref=group_header&view=permalink&id=1448438015203912

মন্তব্যসমূহ

  1. merit casino slot【WG】jokerspins casino slot
    jokerpins casino slot【WG98.vip】⚡,jokerspins 샌즈카지노 casino 메리트카지노총판 slot,jokerspins casino slot,jokerspins casino 1xbet slot,jokerspins casino slot,jackpot slot

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

চৈতন্য হত্যার অনুসন্ধানে - তমাল দাশগুপ্ত

প্রথম পর্ব  পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের পাণ্ডাদের মধ্যে একটা ভীষণ প্রবাদ চালু আছে, মালীবুড়োর শ্রীচৈতন্যের অন্তর্ধান রহস্য বইটা আমাদের জানাচ্ছে। এই পাণ্ডারা অনেকেই গর্ব করে বলে যে চৈতন্যকে তাদের পূর্বপুরুষেরা হত্যা করেছিল। কেন করেছিল? এরা বলে, এর কারণ চৈতন্য নাকি বাংলার মুসলমান শাসকের চর ছিলেন! আর তাই চৈতন্যর উড়িষ্যায় আগমনের পরেই প্রথমবারের জন্য গৌড়ের মুসলমান শাসক উড়িষ্যায় সফলভাবে হামলা করতে পেরেছিল। সাহসীজন এ ব্যাপারে পুরীতে গিয়ে উড়িয়া পাণ্ডাদের মধ্যে খোঁজখবর করে দেখতে পারেন এরকম একটা কথা চালু আছে কি না । চৈতন্য আন্দোলনের ফলে উড়িষ্যায় মুসলমান হামলা হয়েছিল, এই বক্তব্য এমনই জোরালো হয়ে ওঠে ক্রমে, যে প্রভাত মুখার্জি তার মেডায়েভাল বৈষ্ণবিজম ইন ওড়িশা গ্রন্থে এটিকে রীতিমত তথ্য ও যুক্তি দিয়ে খণ্ডন করেছেন, অর্থাৎ এটি উড়িয়ে দেওয়ার মত অকিঞ্চিতকর প্রলাপ নয়, অনেক উড়িষ্যাবাসী এতে বিশ্বাস করেন। ইন ফ্যাক্ট খোঁজ নিলে দেখবেন, অনুরূপ চাপা চৈতন্যবিদ্বেষ বাংলাভাষী হিন্দুত্ববাদীদের অনেকের আছে, এরাও একইরকম মনে করে। আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি যে চৈতন্যর সাম্যময় ভক্তি আন্দোলনের ফলে পাণ্ডাদের মৌরসীপ

বাংলায় ব্রাহ্মণ

একদা এঁরা বাংলায় আসেন, রাজাদের পৃষ্ঠপোষণায় জমিজিরেত ও হরেক সুবিধা ভোগ করেন। অতঃপর আদিশূর নামে আধা-কল্পিত এক চরিত্রকে ঘিরে নিজেদের সামাজিক মর্যাদা আরও বাড়িয়ে নেন, সেই অনুযায়ী স্মৃতি, শাস্ত্র ও কুলজিগ্রন্থ রচনা করেন। ক্রমশ বৈদিক, রাঢ়ী, বারেন্দ্র, কুলীন, ভঙ্গ ইত্যাদি হরেক ভাগে বিভক্ত হয়ে যান। এঁরাই  বাঙালি ব্রাহ্মণ! কুণাল চক্রবর্তী ২৭ মে, ২০১৮, ০০:৩৪:৩৪ ব্রাহ্মণরা বাংলার আদি অধিবাসী নয়। বস্তুত দীর্ঘ দিন বাংলা ব্রাহ্মণদের প্রভাবসীমার বাইরে ছিল। বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকের নৃতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিকেরা লক্ষ করেছিলেন, ‘আর্য’রা পূর্ব ভারতে কিছুটা দেরিতে পৌঁছেছিল এবং তাদের অগ্রগতি স্থানীয় মানুষ প্রতিরোধ করেছিল। বাংলা অবশ্য শেষ পর্যন্ত ব্রাহ্মণ্য বলয়ের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল, কিন্তু প্রক্রিয়াটি খুব সহজ হয়নি। ব্রাহ্মণ্যবাদ যে ক্রমশ পূর্ব দিকে বিস্তৃত হচ্ছিল, প্রাচীন ব্রাহ্মণ্য সাহিত্যে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। অথর্ব বেদেই মগধ ও অঙ্গের প্রথম নিঃসংশয় উল্লেখ আছে। এই গ্রন্থটির মতে এ দুটি ছিল ব্রাত্যদের দেশ। বঙ্গের প্রথম দ্বিধান্বিত উল্লেখ পাই ঐতরেয় আরণ্যক গ্রন্থে